Home » কোন পথে বাংলা, ঠিক হবে পঞ্চায়েত ভোটে

কোন পথে বাংলা, ঠিক হবে পঞ্চায়েত ভোটে

সমটা ২০০৮ সাল। তখন বাংলা শাসন করছে বামফ্রন্ট সরকার। প্রবল প্রতাবান্বিত বামেদের সরকার। দু’বছর আগেই ২০০৬ সালে রেকর্ড ২৩৫ আসন জিতে সপ্তমবারের জন্য বাংলার ক্ষমতা দখল করেছে তারা। কিন্তু তারপর‌ই যেন বাংলার রাজনীতির চাকাটা উল্টো দিকে ঘুরে গেল। আরও দাপট দেখানোর পরিবর্তে যেন পিছু হটা শুরু হয় সরকার ও শাসক দল সিপিএমের। আসলে তারা পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছিল। ওই ২০০৮ সালে ছিল রাজ্যের পঞ্চায়েত নির্বাচন। আর সেই ভোটের ফল‌ই কার্যত বদলে দিল বাংলার রাজনীতির গতিপথকে।

কেমন ফল হয়েছিল ২০০৮ এর পঞ্চায়েত ভোটে? জেলা স্তরের ফলাফলে সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্টেরই মোটামুটি আধিপত্য বজায় ছিল। কিন্তু তার মধ্যেই লখিন্দরের বাসর ঘরের ছিদ্রটি দিব্যি দেখা যাচ্ছিল। সকলকে চমকে দিয়ে ওই ভোটেই মুর্শিদাবাদ ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা পরিষদ দখল করে বিরোধীরা। মুর্শিদাবাদের ক্ষমতা যায় কংগ্রেসের হাতে, আর দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলা পরিষদ দখল করে তৃণমূল কংগ্রেস।

এই ফলকে প্রকাশ্যে সিপিএম নেতৃত্ব খুব গুরুত্ব দিতে চায়নি। তবে দলের অভিজ্ঞ সংগঠকরা তখনই অশনি সঙ্কেত দেখেছিলেন। বিশেষ করে কলকাতা লাগোয়া দক্ষিণ ২৪ পরগনার ফল তাঁদের রাতের ঘুম উড়িয়ে দেয়। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ওই জেলার নেতা। তা সত্ত্বেও জেলা পরিষদ হাতছাড়া হওয়ায় অভিজ্ঞ বাম নেতারা বুঝেছিলেন, ইয়ে ইশারা সমাজদার কো লিয়ে কাফি হ্যায়!

পঞ্চায়েত, পুরসভার ভোটে সাধারণত শাসকের অনুকূলেই রায় দেয় জনতা। কিন্তু সেখানে মাত্র দু’বছর আগে বিপুল জনাদেশ নিয়ে সপ্তমবারের জন্য রাজ্যের ক্ষমতায় আসা বামেদের বিরুদ্ধে মানুষের এইভাবে ক্ষোভ ভোট বাক্সে প্রতিফলিত হওয়াটা যে গড়পড়তা বিষয় নয় তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তবে বামেদের জন্য সবচেয়ে আতঙ্কের ইঙ্গিত ছিল গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরের ফলাফলে। নদিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, মালদহ, মুর্শিদাবাদ, দুই ২৪ পরগনা সহ বহু জেলায় গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে একচেটিয়া ভালো ফল করে বিরোধীরা। দীর্ঘদিন দখলে থাকা বহু পঞ্চায়েত হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল বামেদের।

ওই পঞ্চায়েত নির্বাচনের পরের বছর‌ই ছিল ২০০৯ লোকসভা নির্বাচন। সেই ভোটে প্রথমবারের জন্য বাংলায় পরাজিত হয় বামফ্রন্ট। তাদের থেকে বেশি আসনে জয়ী হয় বিরোধীরা। সেই ধারাবাহিকতা মেনেই আরও দু’বছর পর ২০১১ বিধানসভা নির্বাচনে বামেদের হাতছাড়া হয় বাংলার ক্ষমতা।

বামেদের বিপর্যয়ের এই ধারাবাহিকতা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে পরবর্তীতে বহু বিশেষজ্ঞ বলেছেন, ২০০৮ এর পঞ্চায়েত নির্বাচনে যদি বামেরা ধাক্কা না খেত তবে ২০১১ সালে তারা নাও বাংলার ক্ষমতা হারাতে পারত! কারণ হিসেবে তাঁদের যুক্তি, দীর্ঘ বাম শাসনের বিরুদ্ধে অনেকদিন ধরেই সমাজের একটি শ্রেণির মধ্যে ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হচ্ছিল। কিন্তু বামেদের‌ও যে পরাস্ত করা যায়, তাদের বিরুদ্ধে ভোট দিলে ফলাফল পাওয়া যাবে সেটা রাজ্যের বাম বিরোধী ভোটকে আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছিল ২০০৮ এর পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলাফল। সেই কারণেই উপর উপর বামেদের সঙ্গে থাকলেও ২০০৯ এর লোকসভা নির্বাচনে অনেকেই সিপিএম সহ বাকি বাম দলগুলোর প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ভোট দেয়। যে ধারাবাহিকতা চূড়ান্ত পরিণতি পায় ২০১১-র বিধানসভা ভোটে।

এই মুহূর্তে খুব বেশিদূর ভাবার দরকার নেই। কিন্তু রাজ্য-রাজনীতির বর্তমান পরিস্থিতি যে জায়গায় তাতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে আর কয়েক মাস পরই আয়োজিত হতে চলা পঞ্চায়েত নির্বাচন। কারণ এই নির্বাচনে বিরোধীরা যদি একবার ভালো ফল করতে পারে তবে উজ্জীবিত হয়ে উঠবে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল বিরোধী সমগ্র জনমত।

এই ভালো ফলের জন্য বিরোধীদের যে একজোট হতেই হবে তার কোন‌ও মানে নেই। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হবে তৃণমূল কংগ্রেসের ফল ভালো হল না খারাপ। শত বিতর্ক, হাজার দুর্নীতির সত্ত্বেও তৃণমূল যদি নিজেদের ভোট মেশিনারি ব্যবহার করে ২০২৩ এর পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভাল ফল করতে পারে তবে তাদের খুব আশঙ্কার কিছু নেই। কিন্তু সারা রাজ্যের মধ্যে যদি দু-তিনটেও জেলা পরিষদ তাদের হাতছাড়া হয় এবং প্রতিটি জেলায় যদি বেশ কিছু পঞ্চায়েত সমিতি এবং সংখ্যায় বেশি গ্রাম পঞ্চায়েত বিরোধীরা তাদের মত করে দখল করে নিতে পারে তবে কিন্তু ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনের আগে বিপুল চাপে পড়ে যাবে বাংলার শাসক দল।

পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলের খারাপ ফল মানেই আর‌ও তেরেফুঁড়ে আসরে নামবে বিরোধীরা। কিন্তু এক্ষেত্রে বিরোধী রাজনৈতিক দলের থেকেও শাসকদলের বেশি বিপদ ডেকে আনবে তৃণমূল বিরোধী জনমত। বিরোধীরা একজোট না হলেও সেই জনমত নিজের মত করে তৃণমূলকে হারাতে পারে এমন পক্ষকে ঠিক নিজের মত করে বেছে নিতে সক্ষম।

আর ঠিক এই কারণেই আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচন সংঘর্ষবহুল হতে পারে বলে আশঙ্কা। কারণ পঞ্চায়েত ভোটের ফলাফলের গুরুত্ব তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে শুরু করে নিচুতলার নেতাকর্মীরা পর্যন্ত ভালই জানেন। স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখার চেষ্টা করবেন। উল্টোদিকে বিরোধী নেতাকর্মীরাও জানে, পঞ্চায়েত ভোটে যদি একবার তৃণমূলের গড়ে ফাটল ধরানো যায় তবে সোনায় সোহাগা! তাই তারাও মরিয়া হয়ে উঠবে। আর তাছাড়া বাংলার রাজনীতির কুৎসিত ঐতিহ্যই হল নির্বাচন মানেই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ!

সবমিলিয়ে এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচন যেমন আরও অশান্তিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা, তেমনই বাংলার রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণেও তা মোড়ের কাজ করবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Click to Go Up
error: Content is protected !!