Home » শিবপুরের প্রাচীন ও জাগ্রতা মা হাজারহাত কালীর মাহাত্ম ও মন্দিরের ইতিহাস

শিবপুরের প্রাচীন ও জাগ্রতা মা হাজারহাত কালীর মাহাত্ম ও মন্দিরের ইতিহাস

হাওড়া শিবপুরের মন্দিরতলায় অবস্থিত ওলাবিবিতলার অতি প্রাচীন মা হাজার হাত কালীর মন্দিরে|এই মায়ের অত্যন্ত জনপ্রিয়তা এ মাহাত্ন ছড়িয়ে পড়েছে আজ হাওড়া সহ গোটা বাংলাই নয়,এমনকি সারা ভারতেও|দক্ষিন ভারতীয় রাও এই মায়ের ভক্ত আজ|সে কিভাবে হেলো,সে কথায় পরে আসৃছি|প্রথমে এই মায়ের মুর্তি প্রকাশ ও শুরুর ইতিহাসটা বলি…
প্রায় দেড় শতাধিক বছরের প্রাচীন এই দেবী ও তার ইতিহাস|এই দেবীর মুর্তি প্রকাশ ঘটেছে মাতৃসাধক তথা তন্ত্রসাধক আশুতোষ মুখেপাধ্যায়ের মাধ্যমে|তিনি ছিলেন উত্তর কোলকাতার চোরবাগান অঞ্চলের বাসিন্দা|চাকুরি করতেন তিনি|কিন্তু মন পড়ে থাকতো মাতৃসাধনায়|মায়ের ধ্যান পুজা জপ নিয়েই মশগুল থাকতেন তিনি|সারা দেশে নানা তীর্থস্থানেও ঘুরে বেড়াতেন|একসময় তাঁর সাধনায় দেবী প্রসন্না হন ও তাঁকে স্বপ্নাদেশে দেখা দেন|সেই স্বপ্নেই দেবী চন্ডী তাঁকে সহস্রভুজা কালীর রুপে দর্শন দেন এ আদেশ দেন,তিনি এই রুপেই প্রকাশিতা হতে চান,সাধকের হাতে এবং পুজা পেতে চান|দেবী নিজের অবস্থানের স্থানটিএ নির্দেশ করে দেন|


দেবীর নির্দেশিত সেই স্থানটি ছিলো আজকের শিবপুর ওলাবিবিতলার সেই স্থান,যেখানে আজ মায়ের মন্দির এ শ্রীবিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত|
এই ভাবে স্বপ্নে মায়ের সেই সহস্রভুজা রুপ দর্শন করে অভিভূত হন সাধক|সালটা ছিলো ১৮৭০|দেরি না করেই তিনি শিবপুর ওলাবিবি তলার স্থানীয় হালদার পরিবারের কাছ থেকে ১২৫ টাকা দিয়ে তিন কাঠা জমি কেনেন |কিন্তু দেবীর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠী ও মন্দির নির্মানে অসমর্থ ছিলেন তিনি|তবে মায়ের ইচ্ছাতেই সব ঠিক হয়ে গেলো|দেবীর স্বপ্নাদেশের কথা জানতে পেরে,এগিয়ে আসেন স্থানীয় বাসিন্দারা এবং সেই হালদার পরিবার|সকলের অর্থ সাকুল্যে গড়ে উঠলো মায়ের মাটির মন্দির|সেই মন্দিরেই নির্মিত হোলে মায়ের মাটির প্রতিমা|সাধকের স্বপ্নে দেখা দেবীর অবয়ব হুবহু নির্মান করলেন কুমোরটুলির তৎকালীন প্রখ্যাত শিল্পি প্রিয়নাথ পাল মহাশয়|দেবীর দুটি হাত প্রধান এবং বাকি হাতগুলি পিছনের চালিতে এঁকে হাজার হাতের রুপ দেওয়া হয়েছিলো|এই ভাবেই শুরু হয় দেবীর পুজো|প্রতিষ্ঠা হয় বুদ্ধপুর্নিমায়|


যাই হোক, সেই মুর্তি এবং মন্দির বারবার ভগ্ন হয়|সবশেষে ১৯০৫ সালে দেবীর পাকা মুর্তি নির্মানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়|বিত্তশালী হালদার পরিবার অবং স্থানীয় মানুষের সহযোগীতায় দেবীর পাকা মন্দির নির্মিত হয়|এবং দেবীর মুর্তি সিমন্ট,বালি,চুন,সুরকি,ও আমেরিকান প্লাস্টার সহযোগে নবনির্মিত হয় কুমোরটুলির দক্ষ শিল্পির দ্বারা|প্রকান্ড প্রায় ১২ ফুটেরো বেশী উচ্চতার সেই মুর্তির পিছনের চালীতে সারিবদ্ধভাবে নির্মিত হয় দেবীর হাজারটি হাত|দেবীর দুটি হাত প্রধান ও বাকি ৯৯৮ টি হাত পিছনের চালায় সংলগ্ন|

এই গেলো দেবীর প্রাথমিক ইতিহাস|এবার দেবীর রুপের বর্ননায় আসি|দেবীর এই সহস্রভুজা রুপ আসলে শ্রী শ্রী চন্ডীতে বর্নিত দেবীর সহস্রভুজা রুপরই নামান্তর|শ্রী শ্রী চন্ডীর মধ্যম চরিত্রে দেবীর সহস্রভুজা রুপের উল্লেখ রয়েছে|মহিষাসুর নিধনকালে দেবী আদ্যাশক্তি মহামায়া যে নানান রুপে নিজেকে প্রকাশিতা করছিলেন,তাঁদের মধ্যে এই সহস্রভুজা রপটিই এখান্ পুজিতা হচ্ছেন|দেবী এখানে উজ্জল সবুজাভ নীলবর্না|তিনি ত্রিনয়নী|গোলাকার নয়নগুলি|প্রসান্ত দন্তবিকশিত প্রসন্ন মুখমন্ডল|খানিক শান্ত খানিক ভয়াল দর্শনা|দেবীর মাথায় পঞ্চফুলের মুকুট|দেবীর গলদেশে দুইপাশে রয়েছে নাগহার|তাঁর প্রসারিত বাম হাতে খড়গ এবং ডানহাতে পঞ্চশূল|দেবীর বামপদ স্থাপিত মহাসিংহের উপর এবং ডানপদ মহাপদ্মের উপর|দেবীর সবস্ত্রা|সালংকারা দেবী|বস্ত্র অলংকার এ ফুলের মালায় সজ্জিত করা হয় দেবীকে|হাতে থাকে চাঁদমালা|দেবীর পদতলে শিব নেই,এবং লোলজিহ্বাও নন|তিনি চন্ডী এ কালীকার সংমিশ্রিত রুপে বিরাজমানা|

মায়ের মন্দিরের অভ্যন্তরে দেওয়ালে ব্রহ্মানী,নারায়নী,মাহেশ্বরী,কৌমারী,নারসিংহী,বারাহী আদি দেবী শক্তিগনের এবং মহিৃষাসুরের অঙ্কিত পটচিত্রও রয়েছে|মায়ে

র হাজারটি হাত নাকি সঠিক ভাবে গুনে শেষ করা যায়না,এমনটাই বিশ্বাস|আসলেই যে তিনি বিশ্বমুর্তি,তিনি আদি অন্তহীনা|
এলাকাবাসীদের কাছে মা অত্যন্ত জাগ্রতা|শুধু এই বাংলায় নয়,এৃই মায়ের মাহাত্মকথা ছড়িয়ে পড়েছে আজ দক্ষিন ভারতেও|জনশ্রতি যে,১৯৬০ সাল নাগাদ কৃষ্ণা সুব্রহমন্যম নামে এক তামিল ব্যাক্তি আসেন এখানে মায়ের পুজা দিতে|তিনি ছিলেন দৃষ্টিহীন|মায়ের কাছে চোখের দৃষ্টি ফিরে পাওয়ার জন্য প্রার্থনা জানান|মায়ের কৃপায় একবছরের মধ্যেই নাকি তিনি চোখের দৃষ্টি ফিরে পান|এরপর তিনি নিজ দেশে ফিরে গিয়ে সেখানকার তামিল বাসিন্দাদের কাছে,এই মায়ের মহিমা প্রচার করেন|সেই থেকে তামিল ভক্তরা মায়ের টানে ছুটে আসেন প্রতিবছর শ্রাবন মাসের সময়|শ্রাবন শুক্লপক্ষের শুক্রবার গুলিতে সেই তামিল ভক্তরাই মায়ের পুজার আয়েজন করেন|তাঁরাই তাঁদের মতো দক্ষিন ভারতীয় রিতির ভোগরান্না করে মা কে নিবেদন করেন|মায়ের এ সেই সময় বাঙালি মাছ ভাত ছেড়ে দক্ষিনি পদে ভোগ গ্রহন করেন|সেই সময় দেবীর ভোগে,টক ভাত,ঝাল ভাত,মিষ্টি ভাত,দইবড়া,সাম্বার,উত্তপম আদি দক্ষিন ভারতীর পদে ভোগ নিবেদিত হয়|


এবার আসি,মায়ের নিত্যপুজার কথায়|প্রতিদিন সকাল ৬.৩০ টায় মন্দির খোলে,দুপুর ২ টো পর্যন্ত|এবং সন্ধায় ৫ টা থেকে রাত্রি ৯ টা পর্যন্ত মন্দির খোলা থাকে|দেবীর নিত্যপুজা হয় তন্ত্রমতে|তবে এখানে কোনোকালেই বলিপ্রথার প্রচলন নেই,তাই বলি হয়না|দেবীর নিত্য ভোগে থাকে,ৃভাত,ডাল,তরিতরকারী,ভাজাভুজি,মাছের পদ,পায়েস ও ফল মিষ্টান্নাদি|
মায়ের বাৎসরিক পুজা হয় সাড়ম্বরে বুদ্ধপুর্নিমার দিন,যেদিন মায়ের মুর্তি প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো|এবং আরেকটি বিশেষ পুজা হয় দীপান্বিতা অমাবস্যার কালীপুজায়|এই দুটি দিন সাড়ম্বরে হয় মায়ের বিশেষ পুজা|সেই সময়ে অগনিত ভক্ত দর্শনার্থীর ঢল নামে মায়ের মন্দিরে|প্রতিবছর কালীপুজার আগে দেবীমুর্তির অঙ্গরাগ করা হয়|

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Click to Go Up
error: Content is protected !!