শারদীয়ার হাওয়া মানেই যেন বাঙালির হৃদয়ে ঢেউ তোলে এক অন্যরকম আবেগ। কিন্তু এই আবেগ কেবল মণ্ডপ আর প্রতিমার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বাংলার একাধিক বিখ্যাত মানুষ, যাঁরা নিজের কর্মে ইতিহাস রচনা করেছেন, তাঁদের ঘরের দুর্গাপুজোও হয়ে উঠেছে কালজয়ী — কখনও ঐতিহ্য, কখনও প্রতিরোধ, আবার কখনও নিছক আবেগের গল্প।
চলুন ঢুকে পড়ি সেইসব বিখ্যাত বাড়িগুলির অন্দরমহলে, যেখানে দুর্গাপুজো মানেই শুধুই পুজো নয়, বরং একেকটা সময়কে ধারণ করে রাখা এক জীবন্ত ইতিহাস।

১. শিলাইদহ ও রবীন্দ্রনাথ: শারদের শব্দে ছায়াময় কবিতা
রবীন্দ্রনাথের সময় শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে দুর্গাপুজোর আয়োজন হত রাজকীয় ভাবে। ঠাকুর পরিবারের পূর্বপুরুষেরা সেখানে ধুমধাম করে পুজো করতেন। ছোটবেলায় কবি সেই পুজোর প্রস্তুতি দেখেই বড় হয়েছেন। মৃন্ময়ী প্রতিমার সামনে দীপ্ত আলো, ঢাকের বোল, ভোগের সুগন্ধি — এই সব মিলিয়ে তাঁর শৈশবের পুজো স্মৃতি গভীর ছাপ ফেলেছিল।
যদিও রবীন্দ্রনাথ নিজে পরবর্তীতে পুজোর রীতিতে সরাসরি অংশ নেননি, তাঁর কবিতায় বারবার ফুটে উঠেছে শরতের রূপ, মা দুর্গার রূপক। “নবাঙ্কুরে নবজীবনে জাগিছে নব আশা” — এই পঙক্তিগুলি হয়তো সেই শারদ আবহেরই ছায়া।
তাঁর ‘পূজা’ কবিতায় দেখা যায়, মা যেন শুধু দেবী নন, তিনি শক্তি, তিনি মমতা, তিনি মানবতার আদিম রূপ। দুর্গাপুজো রবীন্দ্রনাথের কাছে ছিল আত্মিক উপলব্ধি, যা শাস্ত্রীয় গণ্ডির বাইরেও যায়।
/indian-express-bangla/media/media_files/jus6PpskdgGE9zL4mrAD.jpg)
২. নেতাজি ও এলগিন রোড: এক বিপ্লবীর অর্ঘ্য
কলকাতার এলগিন রোডের বাড়িটি ছিল নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর পৈতৃক ভিটে। সেই বাড়ির দুর্গাপুজো ছিল সম্পূর্ণ পারিবারিক, কিন্তু তা নিয়ে নেতাজির টান ছিল গভীর। বিদেশে থাকাকালীন সময়েও তিনি চিঠিতে জানতে চাইতেন পুজোর খুঁটিনাটি — কে অঞ্জলি দিচ্ছে, মা কী শাড়ি পরেছে, পায়েস হয়েছে কিনা।
একবার বার্লিনে থাকাকালীন নেতাজি তাঁর বোনকে চিঠিতে লেখেন:
“আমার শরীর এখানে থাকলেও মন তো আজ তোমাদের সঙ্গে এলগিন রোডে। আমি মা দুর্গার আশীর্বাদ চাই তোমাদের সবার জন্য।”
এমনকি আজও এলগিন রোডের সেই বাড়িতে পুজো হয়, যেখানে প্রতিমার চেয়ে বেশি মূল্যবান হয়ে ওঠে ঘরে রাখা নেতাজির স্মৃতি, চিঠি আর পরম্পরা।

৩. শোভাবাজার রাজবাড়ি: রাজনীতি, রাজসিকতা ও ধর্মের মিলন
শোভাবাজার রাজবাড়ির দুর্গাপুজো শুধু কলকাতার নয়, ভারতবর্ষের অন্যতম প্রাচীন বারোয়ারি পুজো।
১৭৫৭ সালে রাজা নবকৃষ্ণ দেব এই পুজোর সূচনা করেন পলাশি যুদ্ধের ঠিক পরেই। ইতিহাস বলে, লর্ড ক্লাইভ স্বয়ং সেই প্রথম পুজোর অতিথি ছিলেন। ব্রিটিশ অফিসারদের প্রথম বারের মতো হিন্দু পুজোতে বসিয়ে খাওয়ানোর সাহস দেখিয়েছিলেন রাজা — এক অর্থে এটি ছিল এক সাংস্কৃতিক প্রতিবাদ।
পুজো চলাকালীন সময় রাজবাড়ির ভেতরকার দৃশ্য ছিল অপূর্ব—একদিকে পুরোহিত মন্ত্র পড়ছেন, অন্যদিকে রাজা বিদেশি সাহেবদের পাশে বসিয়ে ভোগ পরিবেশন করছেন। সেই সাহসী সময় আজও টিকে আছে ঐতিহ্য হয়ে।
আজও শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজোয় ঢুকে সেই প্রাচীন অন্দরমহলের ঘ্রাণ পাওয়া যায় — যেন সময় থেমে আছে।

৪. সত্যজিৎ রায়ের পুজো: শিল্পের ছায়ায় পূণ্যস্নান
ভূপেন রায় স্ট্রিটের রায় পরিবারের দুর্গাপুজো ছিল একান্ত ঘরোয়া, কিন্তু তাতে ছিল এক অপূর্ব শিল্পরুচির ছোঁয়া। ছোটবেলায় সত্যজিৎ রায় নিজে পুজোর সময়ে খামারে গিয়েছেন, ছোট ভাইদের সঙ্গে প্রতিমার চোখ আঁকার সময় তাকিয়ে থেকেছেন, আর নিজের হাতে আলো জ্বালিয়েছেন।
একবার এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন:
“পুজোর সময় আমি কোনও সিনেমা দেখি না। বরং পুরোনো গান, প্রতিমা আর ধূপগন্ধেই আমার আনন্দ। এটা শুধু ধর্ম নয়, এটা নস্টালজিয়া।”
‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এর মতো সিনেমায় হয়তো এই শারদ আবহ বারবার ফিরে আসে তাঁর অভিজ্ঞতা থেকেই।
আজও রায় পরিবারের পুজোয় অংশ নেন তাঁর ছেলে সন্দীপ রায়, যারা পিতার মতোই নিষ্ঠা রেখে পুজো পালন করে চলেছেন।

৫. উত্তম কুমার: মহানায়কের মণ্ডপপ্রীতি
উত্তম কুমার ছিলেন একান্তভাবে ‘পুজোপ্রেমী’। পুজোর সময় তিনি কখনোই শ্যুটিং করতেন না। প্যান্ডেল ঘোরা, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দেখা করা, সপরিবারে অঞ্জলি দেওয়া—সবটাই করতেন সম্পূর্ণ সাধারণ মানুষের মতো।
একবার তাঁকে বালিগঞ্জ কালচারাল পুজোয় দেখা গেল এক কোণে দাঁড়িয়ে খিচুড়ি খেতে।
কেউ জিজ্ঞেস করল, “উত্তমবাবু, আপনি এখানে?”
হাসিমুখে উত্তম বললেন, “এই চারটে দিন আমি শুধু বাঙালি, মহানায়ক নই।”
তাঁর মৃত্যুর পরেও বহু পুজো উদ্যোক্তা তাঁকে বিশেষভাবে স্মরণ করেন। অনেক পুজোয় আজও তাঁর ছবি শোভা পায়—যেন মণ্ডপে তিনিও উপস্থিত।
এই সব পুজোর গল্প শুধুই ধর্মীয় নয়। এগুলি বাংলার ইতিহাসের খণ্ডচিত্র, যেগুলি বারবার আমাদের মনে করিয়ে দেয়—বাঙালির পুজো মানেই শেকড়ের সন্ধান, ঐতিহ্যের স্মরণ, আর হৃদয়ের ঘরে আলো জ্বালানো।
নেতাজির ঘরে জাতীয়তাবাদ, রবীন্দ্রনাথের ছায়ায় সাহিত্য, শোভাবাজারে প্রাচীনত্ব, সত্যজিতের ঘরে শিল্প আর উত্তম কুমারের কাছে পুজো ছিল নিছক এক মানবিক আনন্দ। এই সমস্ত গল্প বোনা থাকে কাশফুলের পাশে, শিউলির গন্ধে, ঢাকের তালে।