“নিশিরাত বাকা চাঁদ আকাশে” – এই চিরস্মরণীয় গানের সুরে আজও বাঙালির হৃদয়ে বেজে ওঠে এক আবেগঘন সুর। গানের প্রতিটি সুর, প্রতিটি শব্দ যেন আজও ফিরে ফিরে আসে এক নারীর কণ্ঠে, যিনি ছিলেন সুরের এক জীবন্ত মূর্তি – গীতা দত্ত।

১৯৩০ সালের ২৩শে নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন গীতা রায় (পরবর্তীতে গীতা দত্ত)। জন্মস্থান পূর্ববঙ্গের ফরিদপুর (বর্তমানে বাংলাদেশ)। ছোটবেলায় সঙ্গীতের প্রতি ছিল অদ্ভুত আকর্ষণ। দেশভাগের পরে পরিবারের সাথে চলে আসেন বম্বে (বর্তমান মুম্বই)। সেখানে তাঁর প্রতিভা নজরে পড়ে সঙ্গীত পরিচালক হনুমান প্রসাদের, যিনি গীতার প্রথম গুরু।

গীতার কণ্ঠে ছিল এক অদ্ভুত যাদু – মিষ্টতা, আবেগ, তীক্ষ্ণতা আর গাম্ভীর্যের এক অসাধারণ মেলবন্ধন। হিন্দি ছবির জগতে তিনি হয়ে ওঠেন এক অনন্য গায়িকা, যিনি “ব্রিজ মোহন”, “বাজি”, “প্যাসা”, “সাহিব বিবি অউর গুলাম”, প্রভৃতি চলচ্চিত্রে একের পর এক কালজয়ী গান উপহার দিয়েছেন।

গীতার জীবনের সবচেয়ে আলোচিত অধ্যায় ছিল তাঁর দাম্পত্য জীবন – বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক গুরুদত্তের সঙ্গে। প্রেম, বিয়ে, তারপরে দাম্পত্য কলহ, বিচ্ছেদ – সব মিলিয়ে এক বিষাদময় প্রেমকাহিনি। তবে গীতার হৃদয়ে গুরুর জন্য গভীর ভালোবাসা আজীবন ছিল স্পষ্ট। গুরুর মৃত্যুর পর একরকমভাবে ভেঙে পড়েন গীতা, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হন।

অনেকেই জানেন না, গীতা দত্ত শুধু হিন্দি গানেই নয়, বাংলা গানেও এক অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। বিশেষত হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, সলিল চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর গাওয়া গানগুলি আজও অমলিন।

“তুমি যে আমার”, “না যেয়ো না”, “এ কেমন পাগলামি”, “জানি তুমি থাকো” – এসব গান বাঙালির হৃদয়ে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে। তাঁর গানে ছিল এক আভিজাত্য, এক প্রাঞ্জলতা, যা আজও সুরপ্রেমীদের মন জয় করে।
১৯৭২ সালের ২০শে জুলাই মাত্র ৪১ বছর বয়সে তিনি প্রয়াত হন। অকাল মৃত্যু তাঁর মতো একজন কণ্ঠসাধিকারীর সৃষ্টির জগতে এক অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে রইল।

তাঁর গান আজও রেডিওতে, স্মৃতি মেলায় কিংবা সিনেমার কালজয়ী দৃশ্যে ফিরে আসে। নতুন প্রজন্মের শিল্পীরাও তাঁর গান গেয়ে শিখছেন, অনুপ্রাণিত হচ্ছেন।
গীতা দত্ত কেবলমাত্র একজন গায়িকা ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক সঙ্গীতের কাব্য। তাঁর কণ্ঠে ছিল আবেগের এক অনন্য শক্তি, যা শ্রোতার মনে চিরস্থায়ী ছাপ ফেলে।
আজ তাঁর প্রয়াণ দিবসে, আমরা শ্রদ্ধা জানাই সেই গীতিকারাকে, যাঁর গানে আছে চিরন্তন প্রেম, অভিমান, বিচ্ছেদ আর জীবনের প্রতিটি সূক্ষ্ম অনুভবের প্রতিচ্ছবি।