ঋত্বিক ঘটক—ভারতীয় সিনেমার এমন এক অধ্যায়, যাঁর জীবন এবং সৃষ্টি মূলধারার বাইরে থেকেও চলচ্চিত্রপ্রেমীদের মনে আজও গভীর রেখাপাত করে। সত্যজিৎ রায় ও মৃণাল সেনের সমসাময়িক হয়েও তিনি ছিলেন আলাদা—প্রথাবিরোধী, বিদ্রোহী এবং গভীরভাবে মানবতাবাদী। তাঁর সিনেমা বাণিজ্যিক সাফল্যের আলো না পেলেও চিন্তার খোরাক জুগিয়েছে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে। তাঁর জীবন ও চলচ্চিত্র নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে, তবে এমন কিছু অজানা তথ্য আছে, যা তাঁকে নতুন করে চিনতে সাহায্য করবে।

১. বাল্যকালে অভিনয়ের হাতেখড়ি
অনেকেই জানেন না যে ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্র জীবন পরিচালনা দিয়ে শুরু হয়নি। তিনি অভিনয়ও করেছেন। কৈশোরে নাটকের প্রতি তাঁর গভীর টান ছিল এবং তিনি একাধিক মঞ্চনাটকে অভিনয় করেছিলেন। এমনকি, তিনি নবান্ন নাটকে অভিনয় করেছিলেন, যা সেই সময়ের থিয়েটার আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টি।
২. লেখক ঋত্বিক
পরিচালক হিসেবে তাঁর পরিচিতি বিস্তৃত হলেও, ঋত্বিক ছিলেন একজন শক্তিশালী সাহিত্যিকও। তিনি গল্প, প্রবন্ধ ও নাটক লিখেছেন। তাঁর লেখা ‘রাজা’, ‘দোস্তিদ’, ‘বেদিনীর প্রেম’, ‘বিপ্লবী’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এমনকি তাঁর বহু চিত্রনাট্য চলচ্চিত্রে রূপ পায়নি, তবে এগুলো সাহিত্য হিসেবেও মূল্যবান।

৩. ‘মেঘে ঢাকা তারা’র শেষ সংলাপ ছিল তাঁর ব্যক্তিগত জীবন থেকে নেওয়া
‘মেঘে ঢাকা তারা’ সিনেমার বিখ্যাত সংলাপ—“দাদা, আমি বাঁচতে চাই!”—আসলে ছিল ঋত্বিক ঘটকের ব্যক্তিগত জীবনের প্রতিচ্ছবি। তাঁর নিজের জীবনও ছিল সংগ্রামে ভরা, যেখানে অর্থাভাব, মানসিক যন্ত্রণা, এবং সমাজের ব্রাত্যতার শিকার হয়েছিলেন তিনি।
৪. ছবির মধ্যে রাজনৈতিক দর্শন
ঋত্বিক ঘটক কেবল গল্প বলতেন না, তাঁর সিনেমার প্রতিটি দৃশ্য ছিল রাজনৈতিক। দেশভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যা, সমাজতান্ত্রিক আদর্শ এবং শ্রমজীবী মানুষের কষ্ট তাঁর প্রতিটি সিনেমায় গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। ‘সুবর্ণরেখা’, ‘কোমল গান্ধার’ বা ‘যুক্তি, তক্কো আর গপ্পো’—সবখানেই এই দর্শন স্পষ্ট।

৫. সিনেমার সংগীত রচনায় তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ
ঋত্বিক ঘটকের ছবির সংগীত নির্বাচনের পেছনেও তাঁর অসাধারণ রুচি ছিল। তিনি বাংলার লোকগান ও ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতকে সিনেমার আবহসংগীতে ব্যবহার করতেন। ‘মেঘে ঢাকা তারা’ বা ‘সুবর্ণরেখা’-তে সংগীত ব্যবহারের যে ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা তিনি করেছিলেন, তা সেই সময়ের বাংলা সিনেমার জন্য এক নতুন মাত্রা যোগ করেছিল।
৬. হলিউডেও সুযোগ এসেছিল, কিন্তু ফিরিয়ে দিয়েছিলেন
শোনা যায়, হলিউডের কিছু নির্মাতা ঋত্বিক ঘটকের কাজ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন এবং তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন বিদেশে কাজ করার জন্য। কিন্তু তিনি সেই সুযোগ ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, কারণ তিনি চেয়েছিলেন নিজের দেশ, নিজের সমাজ, নিজের বাস্তবতাকে সিনেমার মাধ্যমে তুলে ধরতে।
৭. মৃত্যুর পরেই প্রকৃত স্বীকৃতি
জীবদ্দশায় তিনি কখনোই জনপ্রিয়তা পাননি, এমনকি তেমন আর্থিক স্বাচ্ছল্যও ছিল না। তাঁর অনেক ছবিই মুক্তির পর দর্শক টানতে পারেনি। কিন্তু মৃত্যুর পর তাঁর সিনেমাগুলো নতুন করে আলোচনায় আসে এবং ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতে তাঁর আসল মূল্যায়ন হতে শুরু করে।

ঋত্বিক ঘটক ছিলেন এক ব্রাত্য পরিচালক—যিনি মূলধারার গডফাদারদের মধ্যে জায়গা পাননি, কিন্তু চিন্তায়, চেতনায় এবং শৈলীতে ছিলেন অনন্য। তাঁর সিনেমা শুধু গল্প নয়, একেকটি আন্দোলন। আজ যখন চলচ্চিত্র নতুন নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও পরীক্ষানিরীক্ষার দিকে যাচ্ছে, তখন ঋত্বিক ঘটকের কাজ আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে।