প্রতিবেদন – সন্দীপ চক্রবর্তী
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম সৃষ্ট “কারার ওই লৌহ কপাট” গানটিতে সঙ্গীত পরিচালক এ আর রহমানের দ্বারা ‘নাপসন্দ্’ সুরারোপ ও পিপ্পা ছবিতে তার ব্যবহার নিয়ে চূড়ান্ত বিতর্কের আগুন এখনো জ্বলছে। দুই বাংলার শিল্পী মহল এবং সঙ্গীতপ্রেমী মানুষ বিভিন্ন ভাবে এই কাজের প্রতিবাদ এখনো করে চলেছেন, যদিও তার বেশীর ভাগটাই অসংঘটিতভাবে। তাই এই প্রতিবাদ তীব্র ভাবে দানা বাঁধতে পারেনি এখনও। কেউ কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন সঙ্গীত পরিচালককে বা তাঁর টীমকে গানটির সুরকে অহেতুক কাটাছেঁড়া করে ঐতিহাসিক মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করার জন্য, কেউ আবার কবির পরিবারকে দায়ী করছেন, দায়িত্ব-জ্ঞানহীন ভাবে মাত্র ২ লাখ টাকার বিনিময়ে গানটির স্বত্ব বিক্রির চুক্তিতে স্বাক্ষর করার জন্যও।
ইতিমধ্যে ছবির প্রযোজক, পরিচালক এবং সংগীত সুরকাররা সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে স্পষ্ট করতে চেয়েছেন যে তাদের এই উপস্থাপনাটি একটি আন্তরিক শৈল্পিক প্রকাশ। এটির প্রয়োজনীয় অভিযোজন, সমস্ত আলাপ আলোচনা, আইনি দিক নিশ্চিত করার পরেই শুরু করেন। তারা এও উল্লেখ করেন যে মূল রচনা এবং প্রয়াত কাজী নজরুল ইসলামের প্রতি তাদের গভীর শ্রদ্ধা রয়েছে, যার অবদান ভারতীয় উপমহাদেশের সংগীত, রাজনৈতিক ও সামাজিক দৃশ্যপটে অপরিসীম। এই অ্যালবামটি তৈরি করা হয়েছে সেই সব নারী-পুরুষের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য তাদের জীবন উৎসর্গ করেছেন এবং তাদের স্বাধীনতা, শান্তি ও ন্যায়বিচারের সংগ্রামের অনুভূতির কথা মাথায় রেখে। যদি তাদের এই কাজ কারোর অনুভূতিতে আঘাত করে বা অনাকাঙ্ক্ষিত কষ্টের কারণ হয়ে থাকে, তবে তারা আন্তরিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থী।
এদিকে, এটিকে কেন্দ্র করে এই বিশ্বখ্যাত বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের পরিবারের মধ্যেই যে কাদা ছোড়াছুঁড়ি শুরু হয়েছে তা একান্তই অপ্রত্যাশিত। বাংলাদেশে বসবাসকারী কবির নাতনি মিষ্টি কাজী ঢাকা থেকে অভিযোগ করেন যে এই চুক্তি সম্পর্কে তাদেরকে কোনো কিছুই জানানো হয়নি কল্যাণী কাজীর পরিবারের পক্ষ থেকে। মিডিয়া মারফত এখন জানতে পারছেন। এই চুক্তি তাদেরকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে স্বাক্ষরিত হয়েছে। তিনি কল্যাণী কাজী ও অনির্বাণ কাজীর এই চুক্তি স্বাক্ষর করার এক্তিয়ার নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। নিউ জার্সিতে বসবাসকারী কল্যাণী কাজীর কন্যা কাজী অনিন্দিতাও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, একটি আইকনিক গানকে কাটাছেঁড়া করা হবে, এমন একটি অদ্ভুত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে শুনে তিনিও যারপরনাই বিস্মিত হয়েছেন। মানুষ তাঁর প্রতিও ঘৃণা উগড়ে দিচ্ছেন এই মনে করে, যে এই চুক্তিতে তিনিও সামিল যেখানে সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে গানটির স্বত্ব সম্পূর্ণভাবে বিক্রি করা হয়েছে। তিনি এও নিশ্চিত করেন যে তিনি কোনো ভাবেই এই চুক্তির সাথে যুক্ত নন। কবি পরিবারের অনির্বাণ কাজীকে সাক্ষী রেখে প্রয়াত কল্যাণী কাজীর (কবির পুত্রবধু) সাথে রয় কাপূর ফিল্মস কতৃপক্ষের যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তা জনসমক্ষে আনার দাবী জানান তিনি।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, ১৯২১ সালের শেষ দিকে, কাজী নজরুল ইসলাম কুমিল্লা থেকে কলকাতা ফেরার পর গানটির রচনা করেন। সে সময়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের ঢেউএ দেশ উত্তাল। দেশবাসীকে স্বাধীনতার আন্দোলনে প্রবল ভাবে উদ্বুদ্ধ করার জন্য তিনি “কারার ওই লৌহ কপাট” গানটি লিখলেন। গানটি স্বাধীনতা-সংগ্রামীদের এতই প্রভাবিত করেছিল যে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার গানটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হন। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুরও খুব প্রিয় ছিল গানটি। গানটির এভাবে আত্মা-হননে আপামর বাঙালীর আবেগে আঘাত লাগা খুবই প্রত্যাশিত। তবে এ প্রসঙ্গে এটাও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে বহুদিন ধরেই অলিখিতভাবে কাজীসাহেবের সমস্ত গান নিয়ে যে “যেমন খুশী করো, যেমন খুশী গাও” এর অলিখিত প্রতিযোগিতা চলে আসছে, তাতে, এই প্রথম কোনো হেভি-ওয়েট প্রতিযোগী হিসেবে এ আর রহমান সাহেবের আগমন। এখন দেখা যাক বাংলার প্রকৃত নজরুল-প্রেমী এবং সঙ্গীতপ্রেমীদের টনক নড়ে কিনা।