বহতা নদী সরকার :
১৪ বছর পর ক্ষমতা হারাল ভারতীয় বংশোদ্ভুত ঋষি সুনাকের কনজারভেটিভ পার্টি। যুক্তরাজ্যের নির্বাচনী ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ভরাডুবি হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের। পরাজয় মেনে নিয়ে কিয়ের স্টার্মারকে অভিনন্দন জানিয়েছেন ঋষি সুনাক। হারের দায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন তিনি। কনজারভেটিভদের খারাপ ফলের জন্য মূলত সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার সংকট, অপর্যাপ্ত জনসেবা এবং নানান ধরনের কেলেঙ্কারিকেই দায়ী করা হচ্ছে।
যুক্তরাজ্যের সংসদের নিম্নকক্ষ হাউস অফ কমন্সে মোট আসন সংখ্যা ৬৫০ টি। সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজন ৩২৬ টি আসন। নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায়, ৪১২টি আসনে জয় পেয়েছে লেবার পার্টি। আর কনজারভেটিভ পার্টি পেয়েছে ১২১ টি আসন। এছাড়া লিবারেল ডেমোক্র্যাটরা ৭১টি আসন পেয়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছে। এর বাইরে স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টির নয়টি আর রিফর্ম ইউকে চারটি আসন নিজেদের দখলে রাখতে সমর্থ হয়েছে।
যুক্তরাজ্যের ক্ষমতায় এখন কিয়ের স্টার্মার। নির্বাচনের ফল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই ঋষি সুনাককে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। কিয়ের স্টার্মারের বিজয়ের পর প্রধানমন্ত্রী অভিনন্দন জানান। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে ঋষি সুনাক ক্ষমতায় থাকতে ভারতের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের সম্পর্ক ভালো ছিল কিন্তু কিয়ের স্টার্মার ক্ষমতা গ্রহণের পর ভারতের সঙ্গে কেমন সম্পর্ক গড়ে উঠবে?
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞগণ মনে করছেন, সরকার পরিবর্তনে ভারতের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের সম্পর্কের বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন আসবে না। কেননা, কিয়ের স্টার্মারের নির্বাচনী ইস্তেহারে ভারতের সঙ্গে এক নতুন সুসম্পর্ক গড়ে তোলার উল্লেখ ছিল। ক্ষমতায় এলে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তিতে জোর দেওয়া হবে, এমনটাই জানিয়েছিলেন স্টার্মার। সম্প্রতি বিভিন্ন নির্বাচনী জনসভা ও যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী ভারতীয়দের সঙ্গে সাক্ষাতেও হবু প্রধানমন্ত্রী বারবার উল্লেখ করেছেন যে কাশ্মীর ইস্যু ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। ভারত ও পাকিস্তান পারস্পরিকভাবে তা মিটিয়ে নেবে।
উল্লেখ্য, ভারতের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের সম্পর্ক ভালো ছিল। কিন্তু জেরেমি করবিন যখন লেবার পার্টির নেতৃত্বে ছিলেন তখন থেকেই সেই সম্পর্কে ফাটল ধরে। ভারত সম্পর্কে জেরেমির সমালোচনামূলক মনোভাবের কারণে লেবার পার্টির সঙ্গে দূরত্ব বৃদ্ধি পায়। যুক্তরাজ্য সরকার কখনওই কাশ্মীর ইস্যুতে নাক গলাতে চায়নি। সেখানে জেরেমির অবস্থান লেবার পার্টিকে বিপদে ফেলে।
২০১৯ সালে জেরেমি নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টি একটি প্রস্তাব পাশ করেছিল। এতে কাশ্মীর ইস্যুতে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের হস্তক্ষেপ করার বিষয় ছিল। যা ভারত সরকার ভালো ভাবে নেয়নি। নয়াদিল্লি ওই প্রস্তাবের তীব্র নিন্দা করে এবং বিবৃতি দিয়ে জানায়, ‘ভোটব্যাংকের স্বার্থে’ এ ধরনের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করছে লেবার পার্টি। যদিও সে সময় ব্রিটিশ সরকার স্পষ্ট জানিয়েছিল, কাশ্মীর ইস্যু ভারত এবং পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক বিষয়। সেখানে হস্তক্ষেপ করতে রাজি নয় ব্রিটেন।
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে লেবার কনফারেন্স হয়েছিল। সেখানে কাশ্মীর সংক্রান্ত বিতর্কিত বিষয় উত্থাপন করা হয়েছিল। কাশ্মীর সংক্রান্ত প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, সরকারি ক্ষেত্রে সংঘাত বন্ধ করতে লেবার পার্টি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কাজ করবে। এটা একমাত্র তখনই সম্ভব হবে যখন ভারত ও পাকিস্তান এক হয়ে কাশ্মীরের শ্রমিকদের পক্ষে কথা বলবে। এমনকি, সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে বলেও আওয়াজ তোলে তুলে লেবার পার্টি নেতৃত্ব।
জেরেমি সরে যাওয়ার পর ২০২০ সালে লেবার পার্টির নেতৃত্বের ভোটে বিপুল জয় পান কিয়ের স্টার্মার। তার পরই দলের নেতৃত্ব চলে আসে তার হাতে। কিয়ের স্টার্মার লেবার পার্টির দায়িত্ব পেয়েই কাশ্মীর ইস্যুতে দলের অবস্থান পরিবর্তনের পথে হাঁটেন। ব্রিটেনে প্রবাসী ভারতীয়দের সঙ্গে কিয়ের স্টার্মার যোগাযোগ বাড়িয়েছিলেন। তার বক্তব্যে বার বার উঠে এসেছে বৈশ্বিক নিরাপত্তা, জলবায়ু সুরক্ষা এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তার ভিত্তিতে ভারতের সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে তোলার কথা।
প্রবাসী ভারতীয়দের সঙ্গে কথা বলার সময় কিয়ের স্টার্মার বার বার স্বীকার করেছেন, কাশ্মীর দ্বিপাক্ষিক সমস্যা। ভারত এবং পাকিস্তান, উভয় দেশ মিলেই এ সমস্যার সমাধান করবে। তাতে লেবার পার্টি কোনো ভাবেই হস্তক্ষেপ করবে না। কূটনৈতিক মহলের মতে, আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সেখানে নতুন সরকার গড়ার পর ভারতের সঙ্গে ব্রিটেনের সম্পর্ক ত্বরান্বিত করাই অন্যতম লক্ষ্য হবে তা বুঝেছিলেন কিয়ের স্টার্মার।