মানকুণ্ডু, নিজস্ব প্রতিনিধিঃ জগদ্ধাত্রী পুজো, দুর্গাপুজোর পর বাংলার অন্যতম জনপ্রিয় এবং বড়ো উৎসবগুলির মধ্যে অন্যতম। যদিও বাংলার নানা প্রান্তে এই পুজো পালিত হয়, চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজো তার আলোর মায়া, সুশোভিত প্রতিমা, এবং অপূর্ব অলঙ্কারের জন্য সর্বত্র বিখ্যাত। দেবীর শোভাযাত্রা যেন এক স্বর্গীয় পরিবেশ তৈরি করে। তবে চন্দননগরের এই পুজোর সূচনা কিভাবে হয়েছিল, তা জানতে গেলে এক গভীর এবং আকর্ষণীয় ইতিহাসে ফিরে যেতে হয়।
চন্দননগরের পুজোর শুরু: রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের স্বপ্নাদেশ
জনশ্রুতি অনুসারে, নদীয়া রাজ্যের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র একবার দুর্গাপুজোর সময় নবাবের হাতে বন্দি হন। কারাগারে বসে দুর্গাদর্শন না পাওয়ায় রাজা অত্যন্ত বিমর্ষ ছিলেন। সেই সময় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে স্বপ্নে দর্শন দেন দেবী জগদ্ধাত্রী এবং কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে তাঁর পূজা করতে নির্দেশ দেন। রাজা মুক্তি পাওয়ার পর সেই স্বপ্নাদেশ পালন করেই জগদ্ধাত্রী পুজোর সূচনা করেন বলে কথিত আছে।
ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী ও জগদ্ধাত্রী পুজোর আরেক গল্প
আরেকটি কাহিনী মতে, ফরাসি শাসনাধীন চন্দননগরের দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী, যিনি রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের ঘনিষ্ঠ ছিলেন, প্রথম চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পুজো শুরু করেন। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পুজোর আয়োজন দেখে ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী মুগ্ধ হয়ে চন্দননগরের চাউলপট্টিতে প্রথম এই পুজোর সূচনা করেন। তবে এই ঘটনার সময়কাল নিয়ে কিছু সন্দেহ রয়েছে বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন।
দাতারাম শূর ও ভদ্রেশ্বরের পুজো
জগদ্ধাত্রী পুজোর সূচনা নিয়ে আরেকটি প্রচলিত কাহিনীতে উঠে আসে দাতারাম শূরের নাম। ১৭৬২ সালে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের দেওয়ান দাতারাম শূর তাঁর বিধবা মেয়ের ইচ্ছায় ভদ্রেশ্বরের গৌরহাটি অঞ্চলে জগদ্ধাত্রী পুজো শুরু করেন। এই পুজো পরে স্থানান্তরিত হয় শিবতলা অঞ্চলে, এবং আর্থিক সমস্যার কারণে কিছুদিন বন্ধ থাকার পর এলাকাবাসীর উৎসাহে আবার শুরু হয়। বর্তমানে এই পুজোটি তেঁতুলতলা পুজো নামে বিখ্যাত।
আজকের চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজো: আলোর ঝলকানিতে ঐতিহ্যের মেলবন্ধন
চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজো আজ কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি এক সামাজিক মিলনমেলাও বটে। দেবীর বিশাল মূর্তি, রূপালী অলঙ্কার, এবং আকাশছোঁয়া আলোর সাজসজ্জা যেন এক মহামিলনের উপলক্ষ্যে পরিণত হয়েছে। দেশের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ এখানে এসে এই অপূর্ব রূপ দেখে অভিভূত হন।
প্রতি বছর এই পুজোকে কেন্দ্র করে সারা বছর ধরে চলে আয়োজনের তোড়জোড়। আলোর মায়া, সংগীতের ঝংকার, এবং হাজারো মানুষের একত্রিত উপস্থিতি এক অনবদ্য পরিবেশ সৃষ্টি করে।
এইভাবে চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজো আজ এক ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়েছে, যার শিকড় গভীরে প্রোথিত এবং যা যুগ যুগ ধরে বাংলার মানুষের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রেরণা হয়ে আছে।
ছবি সৌজন্যে: মধুরিমা মুখোপাধ্যায়