বহতা নদী সরকার
বর্তমান যুগ সভ্যতার যুগ। মানুষ চাঁদে যাচ্ছে। ছুটছে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে। নির্মিত হয়েছে মহাকাশ স্টেশন। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানেরও প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে। মানুষের বিভিন্ন অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। হৃদপিণ্ডের সুচিকিৎসা হচ্ছে। মরণব্যাধী ক্যান্সারও নিরাময় হচ্ছে আজকাল। অদূর ভবিষ্যতে মানুষ অমরত্বের আশায় বুক বাধছে। মানুষের ঘরে ঘরে এখন জায়গা করে নিয়েছে টিভি, ফ্রিজ, ওয়াসিং মেশিন, ওভেন, এসির মত নানান প্রয়োজনীয় জিনিস। ইন্টারনেট আর কম্পিউটার ছাড়া এখন জীবন যেন অচল। সম্প্রতি এর সঙ্গে যোগ হয়েছে এআই ব্যবস্থা। এক দেশ আরেক দেশকে চোখ রাঙাতে নতুন নতুন মারণাস্ত্র হস্তগত করে রেখেছে। পারমানবিক বোমার চেয়ে কয়েকগুণ শক্তিশালী বোমা তৈরি হয়েছে। বলতে গেলে বিশ্ব এখন মানুষের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে।
আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে আমাদের সমাজে যেসব কুসংস্কার ছিল তা অনেকটা কমে গেলেও একেবারে নির্মূল হয়ে যাইনি। সভ্যতার এই চরম লগ্নে দাঁড়িয়ে আজও মানুষ কুসংস্কারকে আঁকড়ে ধরে আছে। পৃথিবীতে এমন অনেক দেশ, শহর, সমাজ আছে যেখানে কুসংস্কার রীতিমত এখনো ভয়াবহ। কোনটা সংস্কার কোনটা কুসংস্কার, কোনটা বিশ্বাস আর কোনটা অন্ধবিশ্বাস তা এখনো অনেক মানুষ বুঝে না।
কিছুদিন আগের ঘটনা। গুজরাটের একজন ডাক্তার ইমরান পাটেলের কাছে একজন মহিলা আসেন তার নয় মাসের একটি শিশুকে নিয়ে। শিশুটির শ্বাসকষ্টের সমস্যায় ভুগছিল। শিশুটিকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখার পর ডাক্তার লক্ষ্য করেন যে, শিশুটির পেটের কাছে একটি গোলাকার পোড়া দাগ। এছাড়া শিশুটির মেরুদণ্ডের কাছে সেলোটেপ দিয়ে একটি এক টাকার কয়েন লাগানো রয়েছে। ডাক্তারবাবু প্রশ্ন করতেই শিশুটির মা উত্তরে বলেন, কয়েনটি বাচ্চার মেরুদণ্ডের হাড় ভালো রাখার জন্য লাগানো হয়েছে। আর পেটের কাছে পুড়িয়ে দিলে নাকি শ্বাসকষ্টের সমস্যা ঠিক হয়ে যায়।
আমাদের সমাজে এখনো অনেক কুসংস্কার চালু রয়েছে। সভ্যতার এই ক্ষণে দাঁড়িয়ে আজও মানুষ কালাজাদুতে বিশ্বাস করে। মানুষকে সাপে কামড়ালে তাকে হাসপাতালে না নিয়ে ওঝার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। গলায়, মাজায় তাবিজ বাঁধা হয় বিভিন্ন রোগ-বালাই থেকে মুক্তি পাবার আশায়। শুভকাজ করতে শুভদিন দেখা হয়। হাত দেখে ভাগ্য বলে দেওয়া হয়। রাশিফল বিবেচনা করা হয়। রাতে নখ কাটতে নিষেধ করা হয়। দোকানে অনেকেই লেবু মরিচ সূতা দিয়ে বেঁধে রাখে যাতে ভালো বেচাকেনা হয় আর কারও নজর না লাগে। বিড়াল রাস্তা পাড় হলে সেই রাস্তা দিয়ে নাকি যেতে নেই, এতে বিপদ ঘটে। ঘরে ঝাঁটা উল্টো করে রাখলে সংসারে অশান্তি বাধে। জুতো উল্টো থাকলে সংসারে ঝগড়া বাড়ে। সন্ধ্যা দিতে গিয়ে প্রদীপ নিভে গেলে সেটা অশুভ লক্ষণ। এছাড়াও আরও অসংখ্য কুসংস্কার প্রচলিত আছে যার বাস্তব কোনও ভিত্তি নেই।
কলকাতার ‘সেন্টার ফর সোশ্যাল স্টাডিজ’ -এর অধ্যাপক বুদ্ধদেব ঘোষ মনে করেন, প্রত্যেকেই তাঁর নিজস্ব বিশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকতে পারেন, যদি সেটা সমাজের বা অন্য কারোর ক্ষতির কারণ না হয়৷ সেটা যেন মানবাধিকার লঙ্ঘন না করে৷ সেটা যেন অমানবিক না হয়৷ যেমন, গ্রামাঞ্চলে কোনো নারীকে ডাইনির অপবাদ দিয়ে তাঁর ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়৷ গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়৷ শিক্ষা ও বিজ্ঞানচেতনার অভাবে এমনি অসংখ্য কুসংস্কার প্রচলিত সমাজে৷ যেমন, ডাইনিবিদ্যা, বান মারা, ঝাঁড়ফুক, হাঁচি, টিকটিকি, তেঁতুল গাছের ভূত, অমবস্যার রাতে ভূত বের হয়, কালো বেড়াল রাস্তা কাটলে অশুভ, যাত্রাকালে ময়ূর দেখলে শুভ ইত্যাদি৷ এটা শুধু হিন্দু সমাজেই আবদ্ধ নয়, মুসলিম সমাজে কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাস আরো ব্যাপক ও কঠোর বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে৷
কুসংস্কারের জন্য সাধারণত শিক্ষার অভাবকে দায়ী করা হয়। ভারতের সমাজ জীবনে কুসংস্কার গভীরভাবে প্রোথিত৷ এর বিরুদ্ধে লড়াই করা যে খুব কঠিন, সেটা জীবন দিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন কুসংস্কার-বিরোধী আন্দোলনকারী ডা. নরেন্দ্র দাভোলকর৷ সতীদাহ প্রথা ছিল, সময়ের প্রয়োজনে বিলুপ্ত হয়েছে। চালু হয়েছে বিধবা বিবাহ। এমনি অনেক কুসংস্কার কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে মানুষ একদিন কুংস্কার থেকে দূরে সরে আসবে। ধীরে হলেও মানুষ তার ভালো-মন্দ বুঝবে। কিন্তু কবে বুঝবে সেটা এখন ভবিতব্যই জানে।