বৈশালী মণ্ডলঃ ব্রিটিশ ভারত বর্তমানে বাংলাদেশের বগুড়া জেলায় ৮ জানুয়ারি ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে তরুণ মজুমদার জন্মগ্রহণ করেন। পিতা বীরেন্দ্রনাথ মজুমদার ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা।
তিনি প্রথমে সেন্ট পলস ও পরবর্তীকালে কলকাতার স্কটিশচার্চ কলেজ থেকে পড়াশোনা করেন।উত্তমকুমার ও সুচিত্রা সেন অভিনীত চাওয়া পাওয়া(১৯৫৯) র মাধ্যমে তিনি প্রথম পরিচালক দুনিয়া তে পা রাখেন এবংতার পরিচালিত প্রথম জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত ছবি কাঁচের স্বর্গ (১৯৬২)। এরপরে পলাতক (১৯৬৩), নিমন্ত্রণ, সংসার সীমান্তে (১৯৭৫), গণদেবতা — এই সব ছবি সমালোচক মহলে বহুল প্রশংসিত হয়।
তার পরিচালিত বালিকা বধূ (১৯৬৭), কুহেলী (১৯৭১), শ্রীমান পৃথ্বীরাজ (১৯৭৩), ফুলেশ্বরী (১৯৭৪), দাদার কীর্তি (১৯৮০), ভালোবাসা ভালোবাসা (১৯৮৫), পরশমণি (১৯৮৮) ও আপন আমার আপন (১৯৯০) বিপুল বাণিজ্যিক সাফল্য লাভ করে।
তাঁর প্রথম উদ্যোগ ছিল উত্তম কুমার এবং সুচিত্রা সেন অভিনীত চাওয়া পাওয়া (১৯৫৯)। এরপর কাঁচের স্বর্গ (১৯৬২) তৈরি করেছিলেন। যাতে দিলীপ মুখার্জী প্রধান চরিত্রে ছিলেন। ১৯৬৫ সালে তিনি দুটি চলচ্চিত্র তৈরি করেন। সৌমিত্র চ্যাটার্জির সাথে একটুকু বাসা এবং বসন্ত চৌধুরীর সাথে আলোর পিপাসা। দুটি ছবিতেই সন্ধ্যা রায় মহিলা চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন।
,;’ ১৯৬৭ সালে তিনি বছরের সেরা আয় করা চলচ্চিত্রগুলির মধ্যে একটি বালিকা বধূ পরিচালনা করেন। তাঁর শ্রীমান পৃথ্বীরাজ বক্স অফিসে বড় সাফল্য লাভ করে।১৯৭৪ সালে তরুণ মজুমদার ফুলেশ্বরী পরিচালনা করেন। সন্ধ্যা রায় প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন।
সেই সময়ের বাংলা সঙ্গীত শিল্পের কিছু বড় নাম (যেমন হেমন্ত মুখার্জি, মান্না দে, সন্ধ্যা মুখার্জি, আরতি মুখার্জি এবং অনুপ ঘোষাল) চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিয়েছেন।১৯৭৯ সালে তরুণবাবু, কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা গণদেবতা পরিচালনা করেন, যেটি সর্বপ্রথম বাংলা চলচ্চিত্র হিসেবে সেরা জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের জন্য ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার’ জিতেছিল। ইংরেজ শাসনাধীন অবিভক্ত বাংলাদেশ হল এই ছবির মূল পটভূমি।
যতীন ও দুর্গার অনুচ্চারিত ভালোবাসার সম্পর্ককে তরুণবাবু কুশলী চিত্রশিল্পীর মতো ছবির পর্দায় পরিবেশন করেছেন।শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি ছোটোগল্পের উপর ভিত্তি করে দাদার কীর্তি (১৯৮০) চলচ্চিত্রে তিনি মহুয়া রায়চৌধুরীকে প্রধান চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ দেন। ১৯৮১ সালে রায়চৌধুরী ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড ইস্ট জিতেছিল।বিখ্যাত অভিনেত্রী সন্ধ্যা রায়কে পরপর চারটি চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সুযোগ দেন তরুণ মজুমদার ― শহর থেকে দূরে (১৯৮১), মেঘমুক্তি (১৯৮২), খেলার পুতুল (১৯৮৩) এবং অমর গীতি (১৯৮৪)। শেষ দুটি ছবি বক্স অফিসে বড় ধরনের বিপর্যয় এনে দেয় এবং গণমাধ্যমের লেখালেখিতে জল্পনা তৈরি করে যে সন্ধ্যা রায় আর দর্শকের মন জয় করতে সক্ষম নন। এরপর তরুণ মজুমদার, তাপস পল এবং দেবশ্রী রায়কে রোম্যান্টিক জুটি বানিয়ে ভালোবাসা ভালোবাসায় অভিনয় করিয়েছিলেন।
ছবিটি বক্স অফিসে বড় সাফল্য লাভ করে। তরুণ মজুমদারের পরিচালনায় তাপস পাল আরও দুটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন, আগমন (১৯৮৮) এবং পরশমনি (১৯৮৮)।তরুণ মজুমদার এরপর আপন আমার আপন (১৯৯০) ছবিতে প্রসেনজিৎ চ্যাটার্জি এবং শতাব্দী রায়ের সাথে তাপস পালকে দিয়ে অভিনয় করান। ছবিটি বক্স অফিসে একটি যুগান্তকারী সাফল্য অর্জন করে।
তরুণ মজুমদার পরিচালিত এবং ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত অভিনীত ২০০৩ সালের বক্স অফিসে সর্বোচ্চ সাফল্য অর্জনকারী চলচ্চিত্র আলো। তার সংগ্রহে রয়েছে চারটি জাতীয় পুরস্কার, সাতটি বি.এফ.জে.এ. সম্মান, পাঁচটি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার ও একটি আনন্দলোক পুরস্কার। ১৯৯০ সালে তাকে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করা হয়।তরুণ মজুমদারের সহকর্মী ও বাঙালি অভিনেত্রী সন্ধ্যা রায়কে বিয়ে করেন। কিন্তু কয়েক বছর পর তাঁদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়। এঘটনায় আঘাত পান তরুণ মজুমদার।বর্ষীয়ান চলচ্চিত্র পরিচালক তরুণ মজুমদার বহুদিন ধরে কিডনির সমস্যা, ডায়বেটিসে ভুগছিলেন।
২০২২ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জুন থেকে কিডনি ও ফুসফুসের সমস্যা নিয়ে কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। মাঝে শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতিও হয়েছিল; কিন্তু ২ রা জুলাই অবস্থার অবনতি হলে তাকে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়। অবশেষে ৪ জুলাই সোমবার ১১টা ১৭ মিনিটে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পরিচালকের ইচ্ছাকে মর্যাদা দিয়ে এসএসকেএম হাসপাতালে দান করা হয় তার চোখ এবং মরদেহ ।