বাকি ভারতে অনেক আগেই শুরু হয়েছে, এবার বাংলার রাজনীতিতেও শুরু হয়ে গেল ‘সার্ভিস প্রোভাইডারের’ যুগ। বিধায়ক, সাংসদ, কাউন্সিলর, পঞ্চায়েত সদস্যদের এবার শুধু এই সার্ভিস প্রোভাইডার হিসেবে দেখবে বাংলার মানুষ। সঠিক করে বললে, এই দেখার দিকে তাদের ঠেলে দেওয়া হল। নেপথ্য শক্তি হিসেবে কাজ করল প্রকাশ্যে উঠে আসা দুর্নীতির কদর্য রূপ।
রাজনীতি মানে আদর্শ। এই আদর্শ যে শুধু সিপিএম, বিজেপি, কংগ্রেস, তৃণমূল, ডিএমকে, শিবসেনার মত দলগুলির আদর্শ তা নয়। ব্যক্তি রাজনীতিবিদেরও এক আদর্শ আছে। এমনটাই বহু যুগ ভেবে এসেছেন, ভাবানো হয়েছে ভারতীয় ভোটারদের। এই ভাবনাটা ধান্দাবাজির থেকে অনেক বেশি ছিল নৈতিকতার মাপকাঠিতে দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে পরিচালিত করার স্পৃহা।
যদিও দক্ষিণ ভারত ও উত্তর ভারতের বহু রাজ্যে রাজনৈতিক দলগুলি তো বটেই, ব্যক্তি রাজনীতিবিদদের আদর্শ ভুলুন্ঠিত হতে হতে ধুলোর সঙ্গে মিহি দানার মত মিশে গিয়েছে বহু আগেই। কিন্তু বাংলায় বাম জমানা পর্যন্ত রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত আদর্শ, মানে তাঁর সততা, ত্যাগ লড়াই এগুলো মোটামুটি বজায় ছিল। তৎকালীন শাসক এবং বিরোধীদল উভয় ক্ষেত্রেই এই নজির দেখা গিয়েছে। আজ যিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনীতির ময়দানে অনুতোভয় হয়ে লড়াইকে তাঁর কোনও বিরোধীও অস্বীকার করতে পারবেন না।
কিন্তু তার পরবর্তীতে আমরা কী দেখলাম? সারদা কাণ্ড দিয়ে শুরু চিটফান্ড কেলেঙ্কারিতেই প্রায় খসে পড়েছিল এই বাংলার রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত আদর্শের মুখোশ। তারপর নারদ কাণ্ডে লুঙ্গি, স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে দিয়ে বা তোয়ালে মুড়িয়ে রাজ্যের একেবারে প্রথম সারিতে থাকা রাজনীতিবিদদের টাকা নিতে দেখা যায়। তারপর আর কিছুই বাকি ছিল না। তবে নিয়োগ দুর্নীতি আর গরু পাচার কাণ্ডকে ঘিরে পার্থ, কেষ্ট, মানিক, শান্তনুরা যে খেল দেখিয়ে চলেছেন তাতে প্রায় অবাক হতেও ভুলে গিয়েছে বাঙালি।
পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বান্ধবী অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে টাকার পাহাড় দেখে নিঃসন্দেহে অবাক হয়েছিল বাংলার মানুষ। কিন্তু ‘বীরভূমের বাঘ’ কেষ্ট ওরফে অনুব্রত মণ্ডলের যে সম্পত্তির খতিয়ান উঠে এসেছে এবং প্রতিদিন আরও একটু একটু করে উঠে আসছে তা দেখে হাঁপিয়ে ওঠা বাঙালি অবাক হওয়ার গুরুদায়িত্ব কাঁধ থেকে নিশ্চিন্তে ঝেড়ে ফেলেছে। এরপর মানিক ভট্টাচার্য, তাপস মণ্ডল, শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়দের ধন-সম্পদের যে ফিরিস্তি বেরিয়ে এসেছে তাতে নেহাত নাবালক বা সরল মতির মানুষ ছাড়া কেউ অবাক হওয়ার চেষ্টা করবেন বলে মনে হয় না!
কিন্তু এর ফল কী হল? শাসক ঘনিষ্ঠ ও তাদের হোমরা চোমড়াদের কুৎসিত কদর্য দুর্নীতির বহর দেখে হাঁপিয়ে ওটা বাংলার মানুষ কাঁধ থেকে অবাক হওয়ার গুরুভার ঝেড়ে ফেলার সঙ্গে সঙ্গে ত্যাগ করে বসেছে রাজনীতিবিদদের আদর্শের নিক্তিতে পরিমাপ করার বিষয়টি।
গড়পড়তা মানুষ বুঝে গিয়েছে, গোটাটাই লস্ট কেস! এখানে নেতাদের মধ্যে আদর্শ খুঁজতে যাওয়া মানে যেচে পড়ে ঠকে যাওয়া। সবাই ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে আখের গোছাতে ব্যস্ত। যদিও সেটা বললে বোধহয় কম বলা হবে। আসলে ধন-সম্পদ গোছানোর নামে কুৎসিত পরিবেশের জন্ম দিয়ে দিয়েছে এরা। আর এর দায়ভার স্বাভাবিকভাবেই শাসকদলের উপরই চাপবে। কিন্তু তাতেও খুব কিছু যায় আসে না। কারণ বাংলার প্রধান বিরোধী যারা তারাও কমবেশি একই গোয়ালের গরু!
এই অবস্থায় মানুষ কি ভোট দিতে যাবে না? মনে হয় না দীর্ঘ মেয়াদে মানুষের ভোটদানে উৎসাহের উপর এই ঘটনা খুব বড় কোনও প্রভাব ফেলবে বলে। বড়জোর একটা দুটো নির্বাচনে এক-দু শতাংশ ভোট কম পড়লেও পড়তে পারে। যদিও তার সম্ভাবনা বেশ কম। আমজনতা আসলে নিজের মনটাকেই বদলে ফেলেছে। সে ধীরে ধীরে রাজনীতিবিদের মধ্যে সত-অসৎ, ভালো-মন্দ হয়ত আর খুঁজবে না। বরং দেখবে কে তাকে ভালো পরিষেবা দিচ্ছে! পরিষেবা মানে ওই দরকার পড়লে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিচ্ছে, বাড়ির জলের কলের সমস্যা হলে সেটা পুরসভার সঙ্গে কথা বলে ঠিক করে দিচ্ছে, রাস্তাটা মোটামুটি ঠিক করে দিচ্ছে এসব ব্যাপারগুলো আরকি।
স্রেফ সার্ভিস প্রোভাইডার বা পরিষেবা প্রদানকারী হিসেবে রাজনীতিবিদদের গড়ে তোলার পিছনে বাংলার শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের অবদান অনস্বীকার্য। ভালো এবং মন্দ দুই অর্থেই এই দলটি নিজেদের জনপ্রতিনিধিদের ধীরে ধীরে স্রেফ সার্ভিস প্রোভাইডারে পরিণত করেছে। কিন্তু এর বিপদ ভারতীয় গণতন্ত্রের উপর ভয়ঙ্কর।
কত সার্ভিস দেবেন? একজন জনপ্রতিনিধি শুধুই যদি সার্ভিস প্রোভাইডার হিসেবে বিবেচিত হন তবে সাংসদের সঙ্গে বিধায়কের, বিধায়কের সঙ্গে পুর প্রতিনিধি বা পঞ্চায়েত সদস্যের বিবাদ লাগতে বাধ্য। এমনকি তারা প্রত্যেকে একই দলের লোক হলেও বিবাদ, সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে উঠবে এই পরিষেবা প্রদানকে কেন্দ্র করে। আর এই ধরনের সার্ভিস প্রোভাইড করার একটা সীমাবদ্ধতাও আছে। একটা পর্যায়ের পর আর নতুন কিছু দেওয়ার থাকে না। কিন্তু যে সমাজ রাজনীতিবিদের মধ্যে আদর্শ দেখে না, সেখানে যারা নেতা হিসেবে আগামীতে উঠে আসবেন তাঁদের পক্ষে সমাজকে বা জাতিকে নতুন পথ দেখানও কি আদৌ সম্ভব হবে?
আদর্শ বিবর্জিত নেতা কীসের মার্গদর্শন করাবেন? এর ফলে পার্লামেন্ট বা বিধানসভা একদল জড়বুদ্ধি সম্পন্ন লালসাকারীর খোঁয়াড় হয়ে উঠবে না তো? পরিষেবা প্রদানের নেপথ্যে ভারতীয় গণতন্ত্রের শিরা-উপশিরা দিয়ে রক্ত জালিকার মধ্যে ক্রমশই ছেয়ে যাচ্ছে আদর্শহীনতার কালকূট!