Home » ভারতের সব থেকে রহস্যময়ী মন্দির , যার পাতাল ঘর খুলতে সুপ্রিম কোর্টও ভয় পায়

ভারতের সব থেকে রহস্যময়ী মন্দির , যার পাতাল ঘর খুলতে সুপ্রিম কোর্টও ভয় পায়

ভারতের নানান জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অজানা এবং অদ্ভুত কিছু রহস্য যা আজও উন্মোচন করতে পারেননি বিজ্ঞানীরা। তারই মধ্যেয় অন্যতম হল পদ্মনাভ স্বামী মন্দির। এই প্রাচীন মন্দিরটি কেরালার একটি সুন্দর শহর তিরুবনন্ত পুরমে অবস্থিত। মন্দিরের বাইরে রয়েছে একটি বিশালায় ঝিল যা মন্দিরের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।  এই মন্দিরের প্রতিটি অংশই যেন রহস্যে ঘেরা। এই মন্দিরের ইতিহাস খুব কম করে হলেও প্রায় ১৩০০ সাল পুরনো।

শোনা যায় ত্রাবঙ্কর রাজারা ৮ম শতাব্দী তে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এর পরে সময়ের সাথে সাথে এই মন্দিরের জীর্ণ দশা কে নতুন করে রুপ দান করাও হয়েছে। ১৭৫০ সালে ,রাজা মাতণ্ড বর্মা , ভগবান শ্রী পদ্মনাভ স্বামী কে অর্থাৎ বিষ্ণু কে ত্রাবঙ্কর রাজ্য  তার সাথে তাঁর প্রচুর সম্পত্তি সমর্পিত করেছিলেন।  রাজা মাতণ্ড বর্মা পদ্মনাভপুরম কে ত্রাবঙ্কর রাজ্যের রাজধানী করেন। এরপর থেকেই তিনি স্বামী পদ্মনাভর হয়ে রাজ্যের প্রসাশন দেখা শোনা করতেন। রাজা মাতণ্ড বর্মার মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরশুরি রাও একই নিয়ম পালন করে যান। নিজের ২৮ বছরের রাজত্ব কালে রাজা মাতণ্ড বর্মা ত্রাবঙ্কর কে একটি শক্তিশালী রাজ্যে পরিণত করেন। রাজা মাতণ্ড বর্মাই সেই সময়কার সব থেকে শক্তিশালী ডাচ সেনাদের যুদ্ধে হারিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। ডাচ সেনারা হঠাত করেই বেশ কিছুদিন ধরে ত্রাবঙ্কর রাজ্যের ওপর কামানের গোলা বর্ষণ করে যাচ্ছিল। টানা তিন দিন ধরে গোলা বর্ষণ করতেই থাকে ডাচ সেনারা। এরপরেই রাজা মাতণ্ড  বর্মা নিজের বুদ্ধিবল প্রয়োগ করেন। তিনি বেশ কিছু নারকেল গাছের গুড়ি কাটিয়ে গরুর গাড়ির ওপর লাগিয়ে দেন যা দূর থেকে দেখলে কামানের মতই মনে হত। ডাচ সেনারা সেই দেখে ভেবেছিল রাজা মাতণ্ড বর্মার কাছেও প্রচুর কামান ও গোলা আছে , সেই ভয়ে তারা আর ত্রাবঙ্কর রাজ্যের দিকে এগোতে সাহস পায়নি। এর পরেই ৩১ শে জুলাই ত্রাবঙ্কর সেনা সমগ্র ডাচ সেনা দের ঘিরে ফেলে আক্রমন করে এবং তাদের যুদ্ধে হারিয়ে দেয়। ১৯৪৯ অবধি ত্রাবঙ্কর ভারতের অন্যতম প্রধান সাম্রাজ্য ছিল।

চিতুরা থিরুমল বলরাম বর্মা- ২ ছিলেন পরাধীন ভারত থাকা কালিন এই রাজ্যের শেষ রাজা। ১৯৩১ থেকে ১৯৪৯ পর্যন্ত ইনিই এই সাম্রাজ্যে রাজত্ব করেন। ভারত স্বাধীন হবার পর পদ্মনাভ স্বামী মন্দিরে দায়িত্ব এই রাজ পরিবারের হাতেই ছেড়ে দেওয়ায় আজও এই রাজ পরিবারের উত্তরসুরি রাই এই মন্দিরের ট্রাস্টি হিসাবে রক্ষনাবেক্ষন করে আসছেন।

তিরুবনন্ত পুরম – এই শহরের এই নাম টিও পদ্মনাভ স্বামী মন্দিরের প্রধান দেবতার নামের সাথেই রাখা । তিরুবনন্ত নামের অর্থ হল শ্রী পদ্মনাভ স্বামীর ভুমি। ঐতিহাসিক দের ধারনা এই মন্দির আজ থেকে প্রায় ৫০০০ বছর আগে দ্বাপর জুগে তৈরি হয়েছিল। শোনা যায়, এক সময় শ্রী কৃষ্ণের ভাই স্বয়ং বলরাম এই মন্দিরে পদ্মনাভ স্বামীর দর্শন করতে এসেছিলেন। বলা হয় এই মন্দিরের উল্লেখ স্কন্দ পুরান ও পদ্ম পুরানেও উল্লেখিত আছে।

পদ্মনাভ স্বামী মন্দিরের গর্ভ গৃহে পদ্মনাভ স্বামীর ১৮ ফুট লম্বা মূর্তি যা শেষনাগের ওপর শয়ন অবস্থায় আছে। এই মূর্তি ১২৫০০ টি শালগ্রাম পাথর দিয়ে তৈরি যা নেপালের গণ্ডকী নদী থেকে এখানে আনা হয়েছিল। পদ্মনাভ স্বামীর নাভি থেকে উঠে দাঁড়ানো পদ্ম ফুলের ওপর ব্রম্ভার মূর্তি স্থাপিত করা আছে এবং আশে পাশে রানী, শ্রিদেবী ও ভুদেবীর মূর্তি আছে। পদ্মনাভ স্বামীর এই মূর্তি আলাদা আলদা তিনটি দরজা দিয়ে দর্শন করতে হয় , প্রথম দরজা দিয়ে পদ্মনাভ স্বামীর মাথা ও ছাতি দ্বিতীয় দরজা দিয়ে পদ্মনাভ স্বামীর কোমরের অংশ যেখানে পদ্মের ওপর ব্রম্ভা স্থাপিত আছে এবং শেষ দরজা দিয়ে পদ্মনাভ স্বামীর চরণ যুগলের দর্শন করতে হয়।

প্রাচীন কালে ১৮ ফুটের এত বড় মূর্তি কিভাবে এখানে আনা হয়েছিল সেটিও একটি রহস্য । স্থানীয় মানুষের কাছে শোনা যায় এই পদ্মনাভ মন্দির আগে কাঠের তৈরি কড়া হয়েছিল যা পরে গ্রানাইট পাথরের রুপদান করা হয়। এই মন্দিরে ৩৬৫ টি স্থম্ভ আছে যা বছরের ৩৬৫ দিনের প্রতিনিধিত্ব করে। এই মন্দিরে প্রবেশ করার জন্য রয়েছে কিছু কঠিন নিয়ম। পুরুষ দর্শনার্থী দের ধুতি ও মহিলা দর্শনার্থী দের শাড়ি পরেই দর্শন করতে দেওয়া হয় অন্য পোশাকে মন্দিরে প্রবেশ কড়া নিষিদ্ধ। ১২ বছরের কম মহিলা গাউন পরে প্রবেশ করার অনুমতি আছে। এই মন্দিরে বছরে দুবার সমারোহে উৎসব পালিত করা হয় যাকে থুলম ও মিনম বলা হয়। এই দুটি উৎসব ১০ দিন ধরে চলে এবং গোটা মন্দির কে প্রদীপ দিয়ে সাজানো হয়।

২০০৯ সালে , আই পি এস এবং আইনজীবী টি পি সুন্দর রাজন কেরল হাই কোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করে এই মন্দিরের অর্থ নিয়ে অনৈতিক কাজের অভিযোগ তোলেন। এবং এই আবেদনেই এই মন্দিরের মধ্যেয় থাকা গুপ্ত ঘর ও তাঁর মধ্যে থাকা গুপ্তধনের উল্লেখ করা হয়।  টি পি সুন্দর রাজন পদ্মনাভ মন্দিরের সামনেই থাকতেন এবং দৈনিক দর্শন করতে মন্দিরে প্রবেশ করতেন সেখানেই তিনি মন্দিরের কিছু অনৈতিক লেনদেন ও গুপ্ত ঘরের কথা জানতে পারেন। সেই তথ্য নিয়েই তিনি আদালতের দারস্থ হন।

৩১শে জানুয়ারি ২০১১ সালে কেরল হাই কোর্ট। কেরল রাজ্য সরকার কে এই মন্দিরের দায়িত্ব নিতে বলায় যার বিরোধিতা করে রাজ পরিবার সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেন। সুপ্রিম কোর্ট সব কিছু দেখে পদ্মনাভ মন্দিরের সম্পত্তির পরিমান পরিমাপ কোরতে অডিট করার জন্য পদ্মনাভ মন্দিরের গুপ্ত ঘর খোলার আদেশ দেন। ২৭শে জুন ২০১১ , প্রথম গুপ্ত ঘর খোলা হয়। এই ঘর খোলার ২০ দিন পরই কোন এক অজ্ঞাত কারনে  টি পি সুন্দর রাজন-এর মৃত্যু হয়। এর মধ্যেয়ই মন্দিরের নিচে থাকা আরও ৫ টি গুপ্ত ঘর খুলে ফেলাও হয়েছিল। গুপ্ত ঘর গুলির মধ্যেয় থেকে এত গুপ্তধন পাওয়া যায় যে সরকারি আধিকারিক দের মাথা ঘুরতে থাকে। প্রথম গুপ্ত ঘর থেকেই পাওয়া গেছিল ১ লাখ কোটি টাকার গুপ্তধন। এই ঘরের দরজা ভারি কাঠ ও লোহার দরজা দিয়ে বন্ধ ছিল যা খোলার পর গ্রানাইট পাথরের স্ল্যাব সরিয়ে একটি সিরি খুজে পাওয়া যায় যা নিচের দিকে গেছে , সেখান দিয়ে নিচে গিয়ে অন্ধকারে আলো নিয়ে প্রবেশ করতেই দেখা যায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে ধন সম্পদ। এখানে কিছু বস্তায় ভরা সোনার মুদ্রা পাওয়া গেছে যা Napoleonic, Roman, Mediaval ও Britis কালের । এই সব বস্তা গুলির ওজন ৮০০ থেকে ১০০০ কিলো ওজনের ছিল। অনুসন্ধান কারী দল এর সাথে পান প্রচুর সোনার তৈরি বাসন ,সিংঘাসন ও নানান বস্তু যা মনে করা হয় সেই সময়ের ধার্মিক অনুষ্ঠানে ব্যাবহার করা হত। এর সাথেই পাওয়া যায় হিরে মনি মানিক্য দিয়ে তৈরি ৪ফুট লম্বা ও ৩ ফুট প্রস্থের একটি বিষ্ণু মূর্তি আর স্বয়ং পদ্মনাভ স্বামী কে বসানোর জন্য ২৮ ফুট লম্বা সোনার সিঙ্ঘাসন । এসবের সাথেই পাওয়া যায় পদ্মনাভ স্বামীর একটি সোনার পোশাক যার ওজন ৩০ কিলো। এসব কিছু ছারাও অনুসন্ধান কারী দল হিরে মনি মানিক্য দিয়ে তৈরি প্রচুর অনান্য সামগ্রির সাথে নানান মূর্তি খুজে পান। সব কিছু মিলিয়ে যার মুল্য নিরধারিত হয় ৮ লাখ কোটি।

এই ৫ টি গুপ্ত ঘর খোলার পর অনুসন্ধান কারী দল ৬ নম্বর গুপ্ত ঘরের দরজার সামনে যেতেই তারা অবাক হয়ে যান।  এই গুপ্ত ঘরের দরজা হাজার চেষ্টা করেও খুলতে পারেনি অনুসন্ধান কারী দল। এই ঘরের ৩ টি দরজা ছিল প্রথমে লোহার মোটা রডের তার পর ছিল ভারি কাঠের দরজা এবং শেষে রয়েছে আরও একটি লোহার ভারি দরজা যার ওপর দুটি শেষ নাগের মূর্তি খচিত রয়েছে। কিন্তু এই ঘরের এই দরজায় নাতো কোন তালা লাগানো আছে নাতো কোন শিকল। স্থানীয় মানুষের ধারনা এই দরজা অশ্তনাগ মন্ত্রের দ্বারা বন্ধ করা আছে এবং যে এই দরজা খোলার চেষ্টা করবে তার তখনই মৃত্যু ঘটবে। আন্দাজ করা হয় এই ঘরে রয়েছে আরও অনেক বেশি গুপ্তধন যা দুটি নাগ পাহারায় থাকে। অনেকে মনে করেন এই ঘর দিয়েই অন্য কোন জগতে জাওয়ার পথ আছে যেখানে স্বয়ং পদ্মনাভ স্বামী থাকেন। এর সাথে সাথে অনেকে এটাও মনে করেন , যেদিন এই ঘরের দরজা খুলে যাবে সেদিনই এই পৃথিবী ধংস হয়ে যাবে।

আপাতত সুপ্রিম কোর্টও এই গুপ্ত ঘর না খোলার নির্দেশ দিয়েছেন। সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন – এই যাবতীয় ধন সম্পত্তি পদ্মনাভ মন্দিরের এবং এর পবিত্রতা বজায় রাখার জন্য এইঘর আর না খোলাই উচিত।

এই কারনে এখনও অবধি এই ৬ নম্বর ঘরটি আজও রহস্যে আবৃত হয়ে আছে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Click to Go Up
error: Content is protected !!