বৈশালী মণ্ডলঃ ১১ জুন, ১৯৬২। লোকে লোকারণ্য আর জি কর হাসপাতাল। এত ভিড়, ঢোকা-বেরোনোর পথ সব বন্ধ। থিয়েটার, সিনে-দুনিয়ার সবাই আসছেন, ঢুকতে পারছেন না। উদ্বিগ্ন, থমথমে মুখের সারি। প্রশ্নের গুঞ্জন। কী হয়েছিল? কী ভাবে হল অ্যাক্সিডেন্ট? সাদা অ্যাম্বাসাডরটা নাকি তুবড়ে গিয়েছে? ড্রাইভার ছিল না? নিজে চালাচ্ছিলেন? মদ খেয়ে?
ডাক্তার না করলেও, মানুষ কি আর ছাড়ে কাটাছেঁড়া? বাতাসে ভাসে আশ্চর্য, বহুবর্ণ এক অভিনেতার ব্যবচ্ছিন্ন শব। কথা-বলা চোখ। দুই ভুরুর একটা তুলে, অন্যটা নামিয়ে আশ্চর্য কৌশলে ডায়ালগ বলতেন, সেই ভুরু। সংলাপের মাঝে ‘পজ’-কে অতুল শিল্পবস্তু বানিয়ে ফেলার সেই কণ্ঠ। বিশু, হারান, মাস্টারমশাই, রহমত, দাদাঠাকুর, বিশ্বম্ভর রায়, কালীকিঙ্কর, ইন্দ্রনাথরা বুঝি আজ ঢুকতে চেয়েও ঢুকতে পারছে না ওই ছ’ফুট, ঋজু শরীরটায়। বাংলা ছবির উত্তম-সুচিত্রা-সুপ্রিয়া-সাবিত্রী-সন্ধ্যার অজস্র কাহিনির আজ পিতৃবিয়োগের দিন!
মাত্র বাষট্টি বছরের জীবন। ১৯০০ সালে জন্ম নেওয়া মানুষটি বাংলা ছবিকে হাত ধরে পৌঁছে দিয়েছেন আধুনিকতার আঙিনায়, বললে ভুল হবে কি? আর মঞ্চের ছবি বিশ্বাসও তো শুধু পটে নয়, ইতিহাসেও লেখা। বাঙালিরা শিল্প নিয়ে কথা কইতে গেলে ‘যুগ’ শব্দটি বলতে বড় ভালবাসেন। রবীন্দ্র যুগ, অহীন্দ্র যুগ। সে কালের থিয়েটার-ভক্তরা বলেন, অহীন্দ্র চৌধুরী-শিশিরকুমার ভাদুড়ীর পর বাংলার মঞ্চে ছিল ছবি বিশ্বাস যুগ।
বারাসতের জাগুলিয়ায় জমিদারি ছিল দে বিশ্বাস পরিবারের। ‘দে’ পদবি, ‘বিশ্বাস’টা নাকি তাঁর পূর্বপুরুষ পেয়েছিলেন আকবর বাদশাহর কাছ থেকে। বাবা ভূপতিনাথ দে বিশ্বাসের চার ছেলের মধ্যে ছোট শচীন্দ্রনাথ। বয়স এক না পেরোতেই মায়ের মৃত্যু। প্রিয়দর্শন শিশুটিকে মা আদর করে ‘ছবি’ নামে ডাকতেন। সেই নামটাই রয়ে গেল আজীবন, ইতিহাসেও!
(ছবিতে- দূর্ঘটনাগ্রস্ত সেই গাড়ি)
।। ছবি বিশ্বাস ।।
ছবি বিশ্বাসের একটি বৈশিষ্ট্য যে তিনি আদ্যপান্ত নাগরিক, অর্থাৎ আরবান। পঞ্চাশের দশকে শহর কলকাতায় বিলিতি কেতাদুরস্ত বঙ্গীয় অভিজাতকুল কেমন ছিলেন, তার একটি নিখুঁত প্রতিচ্ছবি ছবি বিশ্বাস অভিনীত বিভিন্ন চরিত্র। স্যুট-টাই এবং ধুতি-পাঞ্জাবি, দু’টি বেশেই তিনি ঔপনিবেশিক বাংলার একটি চেহারাকে ধরে রেখেছেন। একই সঙ্গে একই শরীরে তিনি বহন করেছেন একটি বিলুপ্ত হয়ে আসা সময়ের দু’রকম ছবি।
তাঁর প্রকৃত নাম ছিল শচীন্দ্রনাথ বিশ্বাস।জন্ম ১৯০০ সালের ১৩ জুলাই। তাঁর অভিনীত চলচ্চিত্রের মধ্যে সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় – জলসাঘর , দেবী , কাঞ্চনজঙ্ঘা এবং তপন সিংহের পরিচালনায় কাবুলিওয়ালা উল্লেখযোগ্য। এ ছাডাও তিনি বহু বাণিজ্য সফল চলচ্চিত্রে পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেছেন। তিনি মঞ্চাভিনয়েও বিখ্যাত ছিলেন। সমাজ, ধাত্রীপান্না, মীরকাশিম, দুইপুরুষ, বিজয়া প্রভৃতি নাটকে ছিল তাঁর উল্লেখযোগ্য অভিনয়। অভিনয় ছাড়াও তিনি ‘প্রতিকার’ এবং ‘যার যেথা ঘর’ নামক ছবি দু’টির পরিচালকও বটে। তবে পরিচালক হিসেবে তিনি বিশেষ সাফল্য লাভ করতে পারেননি।
তাঁর পিতার নাম ভূপতিনাথ। ছবি বিশ্বাসের পরিবার ছিল কলকাতা নিবাসী। যাত্রা ও থিয়েটারে বরাবরই উত্সাহ ছিল ছবি বিশ্বাসের। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় অ্যামেচার থিয়েটার করেছেন শিশির ভাদুড়ী, নরেশ মিত্রের মতো বড় বড় অভিনেতার সঙ্গে। ১৯৩৮ সাল থেকে তিনি পেশাদার হিসেবে নাট্যনিকেতনে যোগ দেন। অ্যামেচার নাটক দিয়ে জীবন শুরু করলেও পেশাদারি রঙ্গমঞ্চেও তিনি নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন।
ছবি বিশ্বাস পেশাদার অভিনেতা হিসেবে চিত্রজগতে এসেছেন অপেক্ষাকৃত বেশি বয়সে। ১৯৩৬ সালে ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে চলচ্চিত্র জগতে তাঁর পদার্পণ। এর পর অজস্র ছবিতে অভিনয় করেন ছবি বিশ্বাস। প্রথম দিকের কয়েকটিতে নায়কের চরিত্রে এবং পরে পার্শ্বচরিত্রে। অসামান্য দক্ষ অভিনেতা ছবি বিশ্বাসের অভিনীত কয়েকটি স্মরণীয় চলচ্চিত্রের মধ্যে অন্যতম – চোখের বালি , শুভদা , কাবুলিওয়ালা , প্রতিশ্রুতি , জলসাঘর , দেবী , সবার উপরে , কাঞ্চনজঙ্ঘা , হেডমাস্টার ইত্যাদি। ১৯৩০ থেকে ১৯৬০-এর দশক জুড়ে তিনি একাদিক্রমে বহু বাংলা চলচ্চিত্রে চরিত্রাভিনেতা হিসেবে অভিনয় করেছেন এবং ব্যাপক দর্শকনন্দিত হন।
ছবি বিশ্বাস ছিলেন সম্ভ্রান্ত জমিদার বংশের ছেলে। জমিদারি গেলেও তাঁর মেজাজটা তাঁকে কোনও দিন ছেড়ে যায়নি। তিনি ছিলেন ‘লাস্ট অফ দ্য অ্যারিস্টোক্রাটস’— তা কী অভিনয়ে, কী পারিবারিক চালচলনে। ছবি বিশ্বাস মূলত সাহেবি এবং রাশভারি ব্যক্তিত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয়ের জন্য খ্যাতিলাভ করেন। তিনি তাঁর জীবদ্দশাতেই নিছকই এক চরিত্রাভিনেতা থেকে একটি বিশিষ্ট রূপকল্পে পরিণত হয়ে ছিলেন। যে কোনও চরিত্র রূপায়ণে তিনি ছিলেন স্বাভাবিক অভিনয় প্রয়াসী অভিনেতা। ছবি বিশ্বাস বললেই একটি বিশেষ উচ্চতা, জলদগম্ভীর স্বর, একটি চাহনি, পদক্ষেপের বিশিষ্ট ধরন দর্শকের মানসপটে ভেসে ওঠে। ছবি বিশ্বাস একের পর এক ছবিতে কার্যত একই ধরনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। সব মিলিয়ে, বাঙালির কল্পনায় তিনি স্বয়ং একটি ‘টাইপ’!
প্রায় প্রতিটি ছবিতে তাঁর অনবদ্য অভিনয়ের জন্য ১৯৫৯ সালে সঙ্গীত নাটক আকাদেমি তাঁকে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার সম্মান জানান।
১৯৬২ সালের ১১ জুন মোটরগাড়ি দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হয়।