বহতা নদী সরকার :
মানুষকে পড়ার কাজ মোটও সহজ নয়। যারা কথা বলতে পারেন তারা সত্যি-মিথ্যে বলে যাচ্ছেন অহরহ। আমরা কজন তাদের মনের কথা পড়তে পারি! মানুষের মুখ দেখে, চোখ দেখে, দেহের অঙ্গভঙ্গি দেখে মনের কথা পড়ার বিদ্যা কজন মানুষের আছে? তারপর যদি হয় মূক ও বধির। তাহলে তো আরও সমস্যা। কিন্তু এই অসাধ্য কাজ রপ্ত করেছেন ব্যারাকপুরের রামেশ্বর বন্দোপাধ্যায় ও তাঁর মেয়ে রজনী বন্দোপাধ্যায়।
রামেশ্বর বন্দোপাধ্যায়ের বাবা ছিলেন একজন মূক ও বধির ব্যক্তি। তাই ছোটবেলা থেকে মূক ও বধিরদের কথা বুঝতে আগ্রহ জন্মায় তাঁর। এই নিয়ে বিস্তর পড়াশোনা শুরু করেন তিনি। রপ্ত করেন মূক ও বধিরদের ভাষা বোঝার আশ্চার্য ক্ষমতা। তাই পুলিশের সন্দেহের তালিকাতে যখন কোনো মূক ও বধির ব্যক্তি থাকেন তখনই তদন্তের জন্য ডাক পড়ে বাবা-মেয়ের। মুক ও বধিরদের জেরা করতে, দোষী না নির্দোষ প্রমাণ করতে জিজ্ঞাসা করেন তাঁরা। এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে চারশো বেশি মামলায় সাহায্য নিয়েছে পুলিশ তাঁদের কাছ থেকে। এবারও নিউটাউনে মহিলা খুনের কিনারা করতে সন্দেহের তালিকায় থাকা নূর মোহাম্মদকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে তাঁদেরই সাহায্য নেন পুলিশ।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে রামেশ্বর বন্দোপাধ্যায় বলেন, কথা প্রসঙ্গে ওই ছেলেটিকে মৃত মহিলার ছবি দেখানোর সময় সে একটু ক্ষেপে ওঠে। তখন আমরা নিশ্চিন্ত হই। কেননা, মৃত মহিলার ছবি দেখে ক্ষেপে যাওয়াটাই আমাদের সন্দেহের কারণ।
রামেশ্বর বন্দোপাধ্যায়ের মেয়ে রজনীও একই পেশায়। তিনিও ছিলেন নূর মোহাম্মদের জেরা সময়। তিনি বলেন, আমি ছিলাম, এসিপি ছিলেন, সাইকোলজিস্ট ছিলেন, অনেক পুলিশ অফিসারও ছিলেন। ওকে যখন বসানো হয় তখন আমরা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছিলাম। আমি লক্ষ্য করি ও আমাদের লিপরিড ফলো করছে। ও শুনতে পাচ্ছে না ঠিকই কিন্তু আমাদের মুখের অভিব্যক্তি দেখে সব বুঝতে পারছে।
নানা প্রশ্নের পর শেষ পর্যন্ত সত্যি কথা বলতে বাধ্য হয় অভিযুক্ত। গড়গড়িয়ে বলে দেয় পুরও ঘটনা। ওর ভাষ্য অনুযায়ী রজনী বন্দোপাধ্যায় বলেন, ও ভাত খাচ্ছিল, আমি ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরি, ও আমাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয়। আমার তখন রাগ হয়। পেছনে একটা আম কাঠ পড়েছিল, ওটা দিয়ে আমি ওর মাথায় আঘাত করি। বাজে কাজ করার পর আমার তখন ভয় হয়, আমাকে কেউ দেখে নেয়নি তো! তখন আমি উনাকে তুলে বাঁশবাগানে ফেলে দেই।
রামেশ্বর ও রজনী বন্দোপাধ্যায়ের দুজনই জানাচ্ছেন, মূক ও বধিরদের ক্ষেত্রে অনেক বেশি সতর্ক হয়ে জেরা করতে হয়। এক্ষেত্রে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হল সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অভিব্যক্তি। সেই অভিব্যক্তি বলে দেয় অভিযুক্ত সত্যি বলছেন না মিথ্যে বলছেন।
বাবা-মেয়ে একটিই আক্ষেপ, গুরুত্বপূর্ণ মামলার তদন্ত করলেও অনেক ক্ষেত্রে আড়ালে থেকে যায় তাঁদের ভূমিকা। এ বিষয়ে রামেশ্বর মুখোপাধ্যায় বলেন, মূক ও বধিরদের ক্ষেত্রে তদন্ত করতে পুলিশের চেয়ে আমাদের ভূমিকা বেশি থাকে। এই কৃতিত্বটা আমরা অনেক সময়ই পাই না।
বহু আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ মামলার ক্ষেত্রে রামেশ্বর ও রজনী বন্দোপাধ্যায় চোখ-মুখ-দেহের অভিব্যক্তির মাধ্যমে মামলার তদন্ত করতে সহযোগিতা করলেও তাদের ভূমিকাটা অনেকক্ষেত্রে অজানা থেকে যায়। সেই আক্ষেপটা বাবা-মেয়ের দুজনেরই রয়েছে।