পয়লা বৈশাখ মানেই এক সময় ছিল ক্যালেন্ডার উল্টে নতুন বছরের প্রথম দিনটিকে ঘিরে সাজানো-পোছানো দোকানপাট, হালখাতা, আতিথেয়তা আর আপ্যায়নের দিন| এই দিনটি ছিল সংস্কৃতি, সম্পর্ক, আর্থিক এবং আবেগের মেলবন্ধনের দিন। কিন্তু আজ, শহরের ব্যস্ত রাস্তায় সে চেনা বৈশাখ যেন কোথাও হারিয়ে গেছে। ২০১৯ সালের অনিকেত চক্রবর্তীর প্রশংসিত ছবি ‘শঙ্কর মুদী’ এই হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যের এক নিঃশব্দ সাক্ষী যা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় সেই দিনগুলোর যখন পাড়ার ছোট মুদি দোকান ছিল প্রতিবেশীসুলভ আন্তরিকতার কেন্দ্রবিন্দু।

ছবির শঙ্কর ছিল একজন সাধারণ দোকানি, যার মুদি দোকানে শুধু চাল-ডাল বিক্রি হতো না, বিক্রি হতো বিশ্বাস, সম্পর্ক আর রোজকার জীবনযাত্রার জ্যান্ত ইতিহাস। শঙ্কর মুদীর চোখ দিয়ে আমরা দেখি কিভাবে শহরের গায়ে বদলের ছোঁয়া লেগেছে| তাঁর দোকান যেন শহরের পাল্টে যাওয়া সমাজব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি—যেখানে হালখাতা হারিয়ে যাচ্ছে হোম ডেলিভারির ছায়ায়, সম্পর্কের উষ্ণতা হারিয়ে যাচ্ছে অনলাইন পেমেন্টে ছাপা ই-রসিদে এবংউৎসব আর ঐতিহ্যের চিহ্নগুলো একে একে মুছে যাচ্ছে ডিজিটাল ডিসকাউন্টের চাপে।

এক সময় এই দিনে পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠরা ছোটদের আশীর্বাদ করতেন, হাতে তুলে দিতেন এক টাকার লাল খামে ভরা ‘বকশিশ’। নতুন জামা পরা, বাড়িতে ফুল আর চালের আলপনা, মিষ্টিমুখ, আর কানে কানে আশীর্বাদের বাণী—এই সব মিলেই ছিল পয়লা বৈশাখের সার্বিকতা। ছোটদের জন্য এটি ছিল আনন্দ, আর বড়দের কাছে এটি ছিল এক আর্থিক পুনর্নবীকরণের সূচনা। দোকানিদের কাছে হালখাতা ছিল শুধুই হিসাবপত্র নয়, এটি ছিল ক্রেতার সঙ্গে সম্পর্ক ঝালিয়ে নেওয়ার উৎসব। চৈত্র সেলের মাধ্যমে বছরের পুরোনো মাল শেষ করে নববর্ষে খোলা হতো নতুন খাতা। দোকানে থাকত সন্দেশের বাক্স, আতিথেয়তা, আর খাতায় সোনালি অক্ষরে লেখা “শুভ নববর্ষ”। আজ সেসব দৃশ্য অনেকটাই বিরল, কারণ বড় শপিং মল আর অনলাইন রিটেল প্ল্যাটফর্মে হালখাতার জায়গা নেই।

পয়লা বৈশাখ কেবলমাত্র আবেগ নয়, এটি বাংলার অর্থনীতিরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।একদিনে কোটি টাকার দেনা-পাওনা মিটিয়ে দিত দোকানিরা, একে অপরের প্রতি প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে। এটি ছিল বাজারে নতুন আর্থিক সম্পর্ক স্থাপনের দিন, নতুন বছরে ব্যবসার শুভ সূচনা। আজ ইএমআই, ক্রেডিট কার্ড আর ডিজিটাল লেনদেনের যুগে সেই সরাসরি সম্পর্ক আর টিকে নেই। সেই সম্পর্কের ভিত্তি শুধুই ডিজিটাল—বড্ড শীতল, বড্ড দূরত্বভরা।
বর্তমান শহুরে জীবনে সময়ের অভাব, পারিবারিক কাঠামোর বদল, এবং প্রযুক্তির দৌড়ে এই সমস্ত ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে। কোথাও যেন আত্মিক সংযোগে ঘাটতি পড়ছে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো জানবেই না—পয়লা বৈশাখ মানে শুধু নববর্ষের শুভেচ্ছা নয়, এটি এক সময় ছিল জীবনের আনন্দময় ছন্দের প্রতীক, বাংলার হৃদয়ের উৎসব।

তবুও, কলকাতার কিছু কোণায় এখনও দেখা যায় পুরনো ঐতিহ্যের ঝলক। উত্তর কলকাতার এক শতবর্ষীয় কাপড়ের দোকানে আজও খোলা হয় হালখাতা। দোকানমালিক বললেন, “অনেকেই আজ আর আসে না। তবুও আমরা খাতা রাখি—কারণ ঐতিহ্যকে ফেলে দিলে, শিকড়টাই তো হারিয়ে যাবে।”

‘শঙ্কর মুদী’ আমাদের সেই শিকড়ের দিকেই চোখ ফেরায়, মনে করিয়ে দেয় যে, এই ছোট ছোট ঐতিহ্যগুলোই আমাদের জীবনের গল্প বলে। পয়লা বৈশাখ এখন শুধুমাত্র একটি তারিখ হয়ে উঠলেও, আমাদের চেষ্টায় এটি আবার ফিরে আসতে পারে রক্তে-মাংসে, সংস্কৃতিতে এবং সাহচর্যে। বলি আমরা ডিজিটাল, কিন্তু হৃদয় কি এখনও অ্যানালগ্ নয়?

নতুন বছরে প্রশ্নটা থেকে যায়—আমরা কি পারব আবার ফিরিয়ে আনতে সেই সোঁদা গন্ধ, সম্পর্কের উষ্ণতা আর আত্মিক সংযোগ? নাকি পয়লা বৈশাখ চিরতরে বন্দি থাকবে শুধু স্মৃতির পাতা আর সিনেমার ফ্রেমে?
