বাংলার লোকসংস্কৃতির অন্যতম আকর্ষণীয় উৎসব হলো ন্যাড়া পোড়া। বিশেষ করে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে এই উৎসবটি বেশ জনপ্রিয়। ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীতে অনুষ্ঠিত এই উৎসব মূলত হোলিকা দহন বা হোলি পূর্ণিমার একটি অংশ। তবে বাংলার মাটিতে এটি কিছুটা ভিন্ন আঙ্গিকে পালিত হয়। কিন্তু, এই ন্যাড়া পোড়ার পেছনে রয়েছে এক গভীর পৌরাণিক কাহিনী। চলুন জেনে নেওয়া যাক এই উৎসবের ঐতিহ্য ও ইতিহাস।
ন্যাড়া পোড়ার পৌরাণিক কাহিনী:

ন্যাড়া পোড়ার মূল কাহিনী জড়িয়ে রয়েছে ভক্ত প্রহ্লাদ, হিরণ্যকশিপু ও হোলিকার সঙ্গে। পুরাণ অনুযায়ী, অসুররাজ হিরণ্যকশিপুর পুত্র প্রহ্লাদ ছিলেন বিষ্ণুর পরম ভক্ত। কিন্তু হিরণ্যকশিপু নিজেকে ঈশ্বর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন এবং প্রহ্লাদকে তার আরাধনা করতে নিষেধ করেন।
প্রহ্লাদ পিতার আদেশ অমান্য করায় হিরণ্যকশিপু তাকে হত্যা করার জন্য নানা ফন্দি আঁটতে থাকেন। অবশেষে, হিরণ্যকশিপু তার বোন হোলিকাকে আহ্বান করেন, যার কাছে ছিল এক জাদুকরী চাদর, যা আগুনে পোড়ার হাত থেকে তাকে রক্ষা করত। পরিকল্পনা অনুযায়ী, হোলিকা সেই চাদর গায়ে জড়িয়ে প্রহ্লাদকে কোলে বসিয়ে অগ্নিকুণ্ডে প্রবেশ করেন। কিন্তু ঈশ্বরের কৃপায় প্রহ্লাদ অক্ষত থাকেন, আর হোলিকা পুড়ে মারা যান।
এই ঘটনার স্মরণে হোলিকা দহন বা ন্যাড়া পোড়া উৎসব পালন করা হয়, যেখানে অশুভ শক্তির বিনাশ ও সত্যের বিজয়ের বার্তা দেওয়া হয়।
বাংলায় ন্যাড়া পোড়া উৎসবের প্রচলন:

বাংলার লোকসংস্কৃতিতে ন্যাড়া পোড়া মূলত চড়ক পূজার সঙ্গে সম্পর্কিত। বেশ কিছু অঞ্চলে চৈত্র সংক্রান্তির সময়ও ন্যাড়া পোড়া পালন করা হয়। বিশেষ করে কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে ন্যাড়া পোড়া একটি জনপ্রিয় রীতি। এর মাধ্যমে পুরনো বছরের দুঃখ-কষ্ট ও দুশ্চিন্তাকে আগুনে পুড়িয়ে নতুন বছরের শুভ সূচনা করা হয়।
ন্যাড়া পোড়ার আধুনিক রূপ ও সামাজিক গুরুত্ব:

বর্তমানে ন্যাড়া পোড়া শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং এটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মিলনের প্রতীক। বিভিন্ন স্থানে বিশেষ অনুষ্ঠান, নাটক ও গান-বাজনার মাধ্যমে এই দিনটি উদযাপন করা হয়। এটি বাংলার লোকসংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার অন্যতম মাধ্যম।
উপসংহার:

ন্যাড়া পোড়া কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি অসত্যের ওপর সত্যের বিজয়, অশুভ শক্তির বিনাশ এবং শুভ শক্তির প্রতিষ্ঠার প্রতীক। যুগে যুগে এই উৎসবটি বাঙালির সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। তাই আমাদের উচিত এই লোকজ উৎসবগুলোর যথাযথ সংরক্ষণ ও চর্চা করা, যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম আমাদের ঐতিহ্যকে ধারণ করতে পারে।