আজকের দুনিয়ায় বিলাসিতা যেন আর শুধু টাকার খেলা নয়, বরং একপ্রকার সামাজিক স্ট্যাটাসের অস্ত্র। আপনি সত্যিই ধনী কিনা, তা এখন আর ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয় — আপনি ধনী দেখাচ্ছেন কিনা, সেটাই মূখ্য। ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুক কিংবা রিলস—সোশ্যাল মিডিয়ার গ্ল্যামারে মোড়ানো জীবন আমাদের এক নতুন ট্রেন্ডে নিয়ে এসেছে: “লোক দেখানো বিলাসিতা”।
লোক দেখানো বিলাসিতা: কোথা থেকে এল এই প্রবণতা?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থনৈতিক বৈষম্যের জমানায় মিডল ক্লাস এবং আপার মিডল ক্লাসের একটা বড় অংশ নিজেকে উচ্চবিত্ত প্রমাণ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এর পেছনে কাজ করছে একাধিক মানসিক ও সামাজিক কারণ:
- সোশ্যাল মিডিয়ার প্রদর্শনপ্রবণতা:
প্রতিটি রিল বা স্টোরি যেন একেকটি “ব্র্যান্ডেড রঙিন জানালা” — যেখানে বাস্তব নয়, দেখানোর ছাঁদই মুখ্য। ঘুরতে যাওয়া মানেই মালদ্বীপ, খাওয়া মানেই মাইকেলিন-স্টাইল, জামাকাপড় মানেই গুচি বা জারা। - FOMO ও ভার্চুয়াল কম্পিটিশন:
“বন্ধুরা যদি পারে, আমি কেন পারবো না?” এই মানসিকতা থেকেই শুরু হয় কৃত্রিম বিলাসিতার প্রতিযোগিতা। EMI-তে আইফোন, ক্রেডিট কার্ডে ডিজাইনার ব্যাগ — সাময়িক আত্মতৃপ্তির জন্য ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক চাপ নেওয়াও মেনে নিচ্ছেন অনেকেই। - ইনফ্লুয়েন্সার কালচার:
জনপ্রিয় ইনফ্লুয়েন্সারদের জীবনযাপন দেখে অনেকেই বাস্তবতা হারিয়ে নিজের সাধ্যের বাইরে গিয়েও অনুসরণ করতে শুরু করেন। অথচ ইনফ্লুয়েন্সারদের বহু কনটেন্টই স্পন্সরড বা সাজানো।
বাস্তবতার সঙ্গে ফারাক: ধনীর মতো জীবনযাপন বনাম প্রকৃত ধনীর জীবন

একাধিক সমীক্ষা দেখাচ্ছে, যারা সোশ্যাল মিডিয়ায় “ধনী” দেখায়, তাদের অনেকেই ঋণে ডুবে। বরং যারা প্রকৃত বিত্তবান, তারা অনেক সময়েই “লো-প্রোফাইল” জীবনযাপন পছন্দ করেন।
প্রকৃত ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে আর্থিক সচেতনতা এবং দীর্ঘমেয়াদী ইনভেস্টমেন্টে আগ্রহ বেশি।
‘ফেক রিচ’ কালচারের অনুসারীরা ঝুঁকি নিয়ে চলেন সাময়িক স্বীকৃতি বা প্রশংসার আশায়।
এর পরিণতি কী?

এই ট্রেন্ডের কিছু ভয়ঙ্কর সামাজিক ও মানসিক প্রভাব আছে:
আর্থিক দুরবস্থা: EMI-তে চলা বিলাসিতার ফল হল ক্রেডিট স্কোর নষ্ট হওয়া, ঋণজালে ফেঁসে যাওয়া।
মানসিক চাপ ও আত্মসম্মানহানী: ‘নিজেকে প্রমাণ করতে হবে’ মানসিকতায় অনেকে হতাশায় ভোগেন।
সমাজে কৃত্রিমতা ও ভেক: বাস্তব এবং ভার্চুয়াল জীবনের ফারাক তৈরি করে এক ধরনের দ্বিচারিতা।
কীভাবে বাঁচবেন এই ফাঁদ থেকে?

সোশ্যাল মিডিয়ার ফিল্টারড বাস্তবতাকে সত্যি ভেবে নেওয়া বন্ধ করুন।
নিজের আর্থিক অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে জীবনযাপন করুন।
ব্যয় নয়, সঞ্চয় ও বিনিয়োগের উপর গুরুত্ব দিন।
নিজের আত্মমূল্যায়ন অন্যের চোখে নয়, নিজের কাজ ও শান্তির মধ্যে খুঁজুন।
উপসংহার
আজকের সমাজে “ধনী না হলেও ধনীর মতো দেখাও” এক নতুন সাংস্কৃতিক ব্যাধি হয়ে উঠেছে। এই ট্রেন্ড যত না ব্যক্তিগত উন্নতির প্রতীক, তার থেকে অনেক বেশি সামাজিক চাপের বহিঃপ্রকাশ। সময় এসেছে নিজেদের সত্যিকারের মূল্যায়নের। কারণ, অর্থ নয়, আত্মসম্মানই সত্যিকার সাফল্যের পরিচায়ক।