তারক হরি, পশ্চিম মেদিনীপুর
আপনার মুখ ফুটে উঠবে মাদুরে! দেশ পেরিয়ে বিদেশে ছড়াচ্ছে সবংয়ের ঐতিহ্যবাহী শিল্প!
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার সবং ব্লককে সাধারণ প্রশাসনিক মানচিত্রে একটি ছোট্ট অংশ বলে মনে হলেও, বাস্তবে এটি এক বিশাল সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার…..
ইতিহাস, শিল্প, ঐতিহ্য ও সৃজনশীলতার এক জীবন্ত নিদর্শন হয়ে উঠেছে এই জনপদ। আর তার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে এখানকার বিখ্যাত মাদুর শিল্প—যা আজ শুধু স্থানীয় জীবিকার উৎস নয়, বরং আন্তর্জাতিক স্তরে বাংলার গর্বের প্রতীক।
সবংয়ের গ্রামগুলো—যেমন সারতা, দাঁররা, চাউল কুঁড়ি,নওগাঁ, বুড়াল প্রভৃতি—যেখানে মাটির বাড়ির উঠোন বা ছাউনি দেওয়া বারান্দা হয়ে উঠেছে শিল্পের কর্মশালা। এখানকার বহু পরিবার প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে নিপুণ হাতে বুনে চলেছেন মাদুর।
তাঁদের হাতে শুধু সাধারণ মাদুরই নয়, তৈরি হয় একের পর এক অভিনব সৃজনশীল পণ্য—রঙিন ও নকশাদার মাদুর, ঝাড়বাতি, হস্তব্যাগ, পুতুল, টুপি এমনকি এমন এক ধরনের কাস্টমাইজড মাদুর যেখানে ফুটে ওঠে মানুষের মুখাবয়ব—যার নাম ‘মতরঞ্জি’।

একসময় শুধুমাত্র স্থানীয় হাটে বা মেলায় বিক্রি হলেও আজ এই শিল্প পৌঁছে গেছে আন্তর্জাতিক বাজারে। কলকাতা, দিল্লি, মুম্বই তো বটেই, ভারতের বাইরেও ইউরোপ, আমেরিকা, জাপানসহ একাধিক দেশে এর রপ্তানি শুরু হয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক হস্তশিল্প প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করে সবংয়ের মাদুর আজ পেয়েছে বিশ্বের নজর।
এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পকে আরও সুসংগঠিত ও আধুনিকরূপ দিতে ২০১৯ সালে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সারতা গ্রামে ভার্চুয়ালি উদ্বোধন করেন মাদুর রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার। ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি শিল্প দফতরের অধীনে গড়ে ওঠা এই গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আজ শিল্পীদের নতুন দিশা দেখাচ্ছে।



এই উদ্যোগের মূল লক্ষ্য ছিল—শিল্পীদের হাতে আধুনিক ডিজাইন ও প্রযুক্তির জ্ঞান পৌঁছে দেওয়া, বাজারের চাহিদা বোঝানো এবং পণ্যের গুণগত মান বৃদ্ধির মাধ্যমে একে আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছে দেওয়া। আজ সেই লক্ষ্য অনেকটাই সফল।
এই শিল্পের উন্নয়ন ও প্রসারে নিরন্তর পরিশ্রম করে চলেছেন স্থানীয় বিধায়ক ও রাজ্যের মন্ত্রী ডঃ মানস রঞ্জন ভূঁইয়া। তাঁর উদ্যোগেই জেলার বিভিন্ন প্রান্তে কর্মশালা, প্রদর্শনী এবং অনলাইন মার্কেটিং প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। শিল্পীদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রেখে তাদের উৎসাহ ও প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে।

মাদুর শিল্পের মুখ – গৌরীবালা দাস
সবংয়েরই গৌরীবালা দাস আজ এই শিল্পের এক উজ্জ্বল মুখ। তাঁর হাতেই তৈরি হয়েছে ‘মতরঞ্জি’ নামের মুখাবয়ব ফুটিয়ে তোলা মাদুর, যা তাঁকে এনে দিয়েছে জাতীয় পুরস্কার।

গৌরীবালার তৈরি একটি বিশেষ মাদুর একবার উপহার হিসেবে তুলে দেওয়া হয়েছিল কেন্দ্রীয় বাণিজ্যমন্ত্রী পীযুষ গোয়েল-এর হাতে—যা সেদিন সংবাদ শিরোনামেও উঠে এসেছিল। একসময় সাধারণ গৃহিণী হিসেবে মাদুর বুনতেন, আজ তিনি বহু নারীর অনুপ্রেরণা।

যদিও এই শিল্প আন্তর্জাতিক মঞ্চে পৌঁছেছে, তবু এর ভিত এখনও কাচা। পর্যাপ্ত কাঁচামালের অভাব, অনিয়মিত বাজার, প্রতিযোগিতামূলক ডিজাইনের অভাব, আর্থিক অনিশ্চয়তা ইত্যাদি এখনো শিল্পীদের চিন্তার কারণ। অনেকেই চান আরও সরকারি সহায়তা, স্থায়ী বিপণন প্ল্যাটফর্ম এবং ব্র্যান্ডিংয়ের সুযোগ।

সবংয়ের মাদুর শিল্প কেবল একটি হস্তশিল্প নয়, এটি এক সাংস্কৃতিক পরিচয়, যা যুগ যুগ ধরে বাঁচিয়ে রেখেছে এখানকার গ্রামীণ নারীদের হাতের ছোঁয়ায়। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে, সবংয়ের এই শিল্প আমাদের শিখিয়ে দেয়—পরিশ্রম, ঐতিহ্য আর সৃজনশীলতা মিলে কিভাবে গড়ে ওঠে গ্লোবাল আইডেন্টিটি।
একদিন এই সব মাদুর শুধু শোওয়ার ঘরে পাতার জিনিস ছিল। আজ সেগুলো শিল্পবস্তু, উপহার, ঘর সাজানোর আইটেম—যার পেছনে লেগে আছে শত শত মেধাবী হাত আর হৃদয়ের ঘাম।