রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যিক জীবনের প্রেরণাসূত্র, তাঁর ‘নতুন বউঠান’ কাদম্বরী দেবীর আত্মহত্যা আজও ইতিহাসের এক অমীমাংসিত অধ্যায়। ১৯ বছর বয়সে কাদম্বরীর মৃত্যু শুধু একটি পরিবারের নয়, এক সম্ভাবনার মৃত্যু হিসেবেও চিহ্নিত হয়। কিন্তু ঠিক কী কারণে এই আত্মহননের পথ বেছে নিলেন তিনি?

❖ ১. মানসিক অবসাদ এবং প্রথম আত্মহত্যার চেষ্টা
বিশেষজ্ঞদের মতে, কাদম্বরী দেবী দীর্ঘদিন ধরেই বিষণ্ণতায় ভুগছিলেন। একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন আগেও। মনোবিজ্ঞান অনুযায়ী, একবার যে আত্মহত্যার চেষ্টা করে, সে পুনরায় চেষ্টা করতে পারে। সেই ধারাবাহিকতায়ই দ্বিতীয়বার, এবং এবার সফল।
❖ ২. নিঃসন্তান জীবনের শূন্যতা এবং উর্মিলার মৃত্যু
কাদম্বরী ছিলেন নিঃসন্তান। আশার আলো হিসেবে দেখা উর্মিলার মৃত্যু তাঁর মধ্যে অপরাধবোধ ও দুঃখের সঞ্চার করে। তিনি নিজের ওপর দোষ চাপাতে থাকেন। আর তখনই রবীন্দ্রনাথের বিলেতে রওনা হওয়ার দিনগুলো তাঁর নিঃসঙ্গতাকে চরমে পৌঁছে দেয়।
❖ ৩. রবীন্দ্রনাথের বিয়ে ও মানসিক ভাঙন
১৮৮৩ সালের ডিসেম্বরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিয়ে হয়। এর চার মাস পরেই কাদম্বরী আত্মহত্যা করেন। নতুন করে নিঃসঙ্গতার আশঙ্কা, সম্পর্কের ভাঙন এবং মনের দহন তাঁকে শেষ করে দেয়।
❖ ৪. স্বামী জ্যোতিরিন্দ্রনাথের অন্য সম্পর্কে সন্দেহ
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের পকেটে পাওয়া এক অভিনেত্রীর চিঠি থেকেই কাদম্বরীর সন্দেহ দানা বাঁধে। এই চিঠিগুলো এবং সুইসাইড নোট পরে ধ্বংস করা হয়, ঠাকুরবাড়ির সম্মান রক্ষার্থে। অনেকে মনে করেন, আত্মহত্যার অন্যতম প্রধান কারণ এটি।

❖ ৫. ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলের ঈর্ষা ও কুৎসা
কাদম্বরী দেবীর সাহসী, স্পষ্টভাষী স্বভাব অনেকের ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মহিলারা তাঁর সম্পর্কে কুৎসা রটাতেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়েও নানা গুজব চলত। এতে কাদম্বরী অপমানবোধে আত্মগ্লানিতে ভুগতেন।
❖ ৬. আত্মহত্যার মাধ্যম : আফিম
বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, কাপড় বিক্রেতা বিশুর মাধ্যমে আফিম সংগ্রহ করে খেয়েই আত্মহত্যা করেন তিনি। যদিও ময়নাতদন্ত হয়নি, তবে পরিবারের অনেকেই আফিমের কথা বলেছেন। কাদম্বরীর পরিকল্পিত আত্মহনন বলে ধরে নেওয়া হয়।
❖ ৭. সাহিত্যিক সম্পর্ক না কি গোপন প্রেম?
সুধীন্দ্রনাথ দত্তের মতে, কাদম্বরী ও রবীন্দ্রনাথ একে অপরের প্রেমে পড়েছিলেন, এবং সেই সম্পর্ক ভেঙে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই রবীন্দ্রনাথের বিয়ে ঠিক হয়। যদিও এই মত বিতর্কিত, এবং বুদ্ধিজীবীরা এর তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন।
❖ ৮. জ্যোতিরিন্দ্রনাথের অপরাধবোধ?
কাদম্বরীর মৃত্যুর পর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ দ্বিতীয়বার বিয়ে না করে আজীবন একাকী জীবন যাপন করেন। এটি হয়ত তাঁর অপরাধবোধের প্রকাশ।
একক কোনও কারণ নয়, বরং একাধিক মানসিক, পারিবারিক ও সামাজিক চাপ কাদম্বরী দেবীর আত্মহত্যার পেছনে দায়ী। রবীন্দ্রনাথের জীবনে কাদম্বরীর প্রভাব ছিল অপূরণীয়, এবং তাঁর মৃত্যুর ছায়া রবীন্দ্রনাথের কবিতায়, স্মৃতিতে ও নীরবতায় চিরকাল রয়ে গেছে।