The Indian Chronicles
বাংলা লোকগানের ইতিহাসে কিছু গান থাকে, যা সময় পেরিয়েও হারিয়ে যায় না—তারা ফিরে আসে নতুন সুরে, নতুন ব্যঞ্জনায়। তেমনই একটি গান ‘আমারে ফ্রড করে’। এক শতাব্দীরও আগে রূপচাঁদ পক্ষী এই গানটি লিখে এবং গেয়ে বাংলা প্রেম ও সমাজ জীবনে ব্যঙ্গাত্মক এক প্রতিবিম্ব রেখেছিলেন। সেই গানই এবার ফিরেছে আধুনিক পরিমণ্ডলে, অদিতি মুন্সীর কণ্ঠে।

কীর্তন, পদাবলি ও ভক্তিগীতির মাধ্যমে সমগ্র বাংলা জুড়ে সমাদৃত অদিতি মুন্সী এবার এক অভিনব সাহসিকতায় এই লোকজ ব্যঙ্গগানটিকে গেয়ে বুঝিয়ে দিলেন—প্রেম, প্রতারণা, অভিমান আর আত্মমর্যাদার লড়াই কেবল ভক্তি নয়, বাস্তবেরও গল্প।
১৯১৮ থেকে ১৯২৫ সালের মধ্যে ‘আমারে ফ্রড করে’ গানটি লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে। গানটির ভাষা ছিল সহজ, কথ্য আর ব্যঙ্গাত্মক—তাতে একজন প্রেমিকের হতাশা, ধোঁকায় পড়া এবং সামাজিক প্রতারণার অভিজ্ঞতা উঠে আসে। গানটি ছিল:
“চিঠি লিখে দিলি তুই প্রেমের,
সিল ছিলো না, ছিল শুধু গেমের।
আমারে ফ্রড করে… ফ্রড করে গো রে!”
গানটি রূপচাঁদ পক্ষীর চেনা লোকভঙ্গিতে হলেও, ভাবনার গভীরতা তাকে জনমানসে গেঁথে দেয়।

প্রখ্যাত কীর্তন শিল্পী অদিতি মুন্সী, যিনি একাধারে সংগীতশিল্পী ও সমাজসচেতন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, তিনি এই গানটিকে কেবল পুনরুজ্জীবন দেননি—তিনি একে বাঙালির হৃদয়ে নতুন করে প্রতিষ্ঠা করেছেন। অদিতির স্বচ্ছ কণ্ঠ, আবেগভরা উপস্থাপনা এবং আধুনিক সংগীতায়োজন গানটিকে এনে দিয়েছে এক অন্য মাত্রা।
তার গায়কিতে গানটি শুধু “মজা করে বলা প্রেমের ব্যর্থতা” নয়, বরং এক সামাজিক প্রতিবাদ—প্রেমের নামে প্রতারণা, সস্তা সম্পর্ক, এবং আত্মমর্যাদা রক্ষার লড়াইয়ের সুর।
গানটির অদিতি-রূপান্তর বাঙালির মনে এক নস্টালজিয়া জাগিয়ে তোলে। হারিয়ে যাওয়া অভিজাত্য, গান শুনে মুচকি হেসে ভেবে নেওয়ার অভ্যাস, প্রতিটি লাইনের মধ্যে সূক্ষ্ম ব্যঙ্গ খুঁজে পাওয়ার ঐতিহ্য—সেটাই যেন ফিরিয়ে দিয়েছেন তিনি।
গানটি কীর্তনের আবহ না রেখে এক আধুনিক লোক-পপ ফর্মে উপস্থাপন করা হয়েছে, কিন্তু তার অন্তরের সুরটি অদিতির কীর্তনী কণ্ঠের আবেশেই বয়ে গেছে। গানটি যেন এক সেতু—প্রাচীন লোকধারা ও আধুনিক শ্রোতার মধ্যে।
এই গান মুক্তি পাওয়ার পরেই সোশ্যাল মিডিয়ায় তা ভাইরাল হয়ে ওঠে। রিলস, মিম, ফ্যান কাভার—সবখানে ছড়িয়ে পড়ে “আমারে ফ্রড করে”। তরুণ প্রজন্ম একে ব্যবহার করছে মজার ভিডিওতে, অথচ অনেকেই টের পাচ্ছে গানটির অন্তর্নিহিত গভীরতা।
একাধিক সঙ্গীত সমালোচক বলেছেন, অদিতির গাওয়া এই গান “লোকগানের পুনর্জাগরণে নতুন দিশা” এনে দিল। বিশেষত, নারী কণ্ঠে প্রেমে প্রতারণার অভিযোগ গাওয়া—এ এক সাহসী সাংস্কৃতিক পদক্ষেপ।
আজকের সমাজে প্রেমে প্রতারণা, সম্পর্কের ভাঙন ও তার পরিণতি একটি সাধারণ বিষয়। কিন্তু তা নিয়ে সরাসরি কথা বলা, বিশেষ করে সাহস করে ব্যঙ্গ করা, অনেকের পক্ষেই কঠিন। এই গান সেই কাজটি করেছে শত বছর আগে—এবং আবারও করছে এখন।
‘আমারে ফ্রড করে’ গানটি দেখিয়ে দিয়েছে—ভাষা ও সংগীত বদলালেও প্রেমের জটিলতা, প্রতারণার অনুভব এবং আত্মমর্যাদার জায়গা চিরন্তন।
রূপচাঁদ পক্ষীর গানের ভাষা, অদিতি মুন্সীর সুর আর বাঙালির হারিয়ে যাওয়া আবেগ—এই তিনে মিলে ‘আমারে ফ্রড করে’ হয়ে উঠেছে এক সাংস্কৃতিক দলিল। যে গান একদিন হাসতে হাসতে কাঁদিয়েছিল, আজ আবার সেই গান আমাদের জীবনের আয়না ধরছে—আধুনিক মুখোশের আড়ালে থাকা ভালোবাসা ও ভাঙনের গল্প বলছে।
বাংলা গানে এ এক নবযুগের সূচনা—যেখানে লোকগান, কীর্তন আর সমসাময়িকতা মিলেমিশে তৈরি হয় নতুন আঙ্গিকের বাস্তব সংগীত।