দুর্গাপূজো মানেই চোখ ধাঁধানো আলো, রাজকীয় থিম, সেলিব্রিটি উদ্বোধন, সরকারী অনুদান ও কর্পোরেট বিজ্ঞাপনের ঝলকানি। কিন্তু এই জাঁকজমকের মাঝেও কোথাও যেন চাপা পড়ে যাচ্ছে সেই ঢাকিদের কণ্ঠস্বর, যাঁদের ঢাকের তালে প্রাণ পায় আমাদের সবচেয়ে বড় উৎসব।

ঢাকের আওয়াজে যাঁরা প্রাণ দেন, তাঁদের গল্প কি শোনা হয়?
পূজোর পাঁচদিন কোলকাতার প্রতিটি মণ্ডপে ঢাক বাজে। ঢাকিরা দাঁড়িয়ে থাকেন প্রতিমার পাশে, তাদের কাঁধে বিশাল ঢাক, গলায় গামছা, চোখে অপেক্ষা—অপেক্ষা আরও ভালো দিন আসার।
অথচ বেশিরভাগ মণ্ডপে একজন মধ্যবয়স্ক ঢাকি আর তার সঙ্গে একজন শিশু—কাঁসরের তালে তাল মিলিয়ে চলা। এই শিশুটির স্কুল নেই, নতুন জামা নেই, নেই কোনও নিরাপত্তা। সে এসেছে বাবা বা কাকুর সঙ্গে, হয়তো সামান্য কিছু টাকার জন্য। পূজোর আনন্দ তার কাছে খালি পেট, আর ঘুমহীন রাতের আরেক নাম।

কর্পোরেট পুজোতে কোটির হিসাব, ঢাকির হাতে কেবল কড়ির জোগান!
আজকের দিনে দুর্গাপূজো বড়ো কর্পোরেট খেলা। বড়ো বড়ো কোম্পানি লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করছে প্যান্ডেল, লাইটিং, থিম আর বিজ্ঞাপনে। সরকারও অনুদান দিচ্ছে লক্ষাধিক টাকার। থিম আর্টিস্ট, ডিজাইনার, বাজেট ম্যানেজার, ইভেন্ট কোম্পানির কর্মীরা পুজোর মরশুমে লাখ টাকা আয় করছেন।
কিন্তু এই ছবির বাইরের মানুষটা—ঢাকি, আজও সেই পুরনো গ্রাম থেকে শহরে এসে ঠাঁই পায় কোন গলির কোণে। পাঁচদিনের জন্য মেলে হাজার খানেক টাকা, থাকা-খাওয়া কোনওরকমে। বৃষ্টি হলে মণ্ডপ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। অনেক সময় নির্ধারিত পারিশ্রমিকও সময়মতো মেলে না।

“পূজো মানেই কাজ”—কিন্তু কাজ কি আনন্দ দেয়?
মুর্শিদাবাদ, মালদহ, নদীয়া, বীরভূম, পূর্ব বর্ধমানের মতো জেলার বহু ঢাকি এখন পুজোর সময় শহরমুখো হন। অনেকেই পুজোর এক মাস আগে থেকেই কলকাতায় চলে আসেন, রিহার্সাল, মহড়া ইত্যাদির জন্য।
তাঁদের অধিকাংশেরই কোনও চুক্তিভিত্তিক সম্মানী নেই। নেই চিকিৎসা, বীমা বা নিরাপত্তার কোনও বন্দোবস্ত। পূজোর আনন্দে যখন শহর মাতোয়ারা, তখন ঢাকিরা রাত জেগে বাজাচ্ছেন—তাও পেট চালানোর দায়ে।

পুজোর শিশুশিল্পী—তাল না মিললে কষে থাপ্পড়!
ঢাকিদের সঙ্গে অনেক সময় আসে তাদের ছোট ছেলেরা বা ভাগ্নেরা। তাদের কাজ হলো কাঁসর বাজানো, বড়দের সাহায্য করা। এরা স্কুল ফেলে আসে, পুজোর কয়েকটা দিন যেন তাদের কাছে পরিশ্রমের এক কঠিন প্রহর। এই বয়সে যখন নতুন জামা, ঠাকুর দেখা, ফুচকা খাওয়ার আনন্দ, তখন তারা দাঁড়িয়ে কাঁসর হাতে অপেক্ষা করে কবে বাজানো শেষ হবে।

কুমারটুলি যেমন আলোকিত, ঢাকির পল্লি তেমন অন্ধকার!
প্রতিমাশিল্পীদের জীবনেও আজ পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। বড়ো বড়ো অর্ডার আসে, মিডিয়ায় কভারেজ হয়, উৎসব-পূর্ব মেলায় বিক্রি হয় প্রতিমার ছবি, নানা আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীর ডাক পড়ে।
কিন্তু ঢাকিদের নিয়ে কোনও আলোচনাই নেই। না কোনও আর্ট ফেস্টিভ্যালে, না কোনও সরকারি প্রকল্পে। “ঢাকি সম্মান” নামে কেউ কোনও পুরস্কার চালু করেনি। অথচ ঢাক না বাজলে দুর্গাপুজোর শুরু হয় না!

কবে আসবে তাদের জন্য পুজোর প্রকৃত আনন্দ?
আজ সময় এসেছে প্রশ্ন তোলার—কেন দুর্গাপুজোর অন্যতম অংশ হয়েও ঢাকিরা বঞ্চিত? কেন তাঁদের শিশুরা আজও শ্রমিক? কেন পুজো উদ্যোক্তারা তাঁদের সম্মানী নিশ্চিত করেন না?
ঢাকি শুধু একজনে নয়, সে এক ঐতিহ্যের ধারক। তার ঢাকের তালে জেগে ওঠে বাংলা, বাঙালিয়ানার অন্তর্নিহিত আত্মা।
আজ যতো না দরকার ডিজাইনার লাইট, তার চেয়েও বেশি দরকার এই শিল্পীদের পাশে দাঁড়ানো। দরকার শিশু ঢাকিদের জন্য বিদ্যালয় সংযুক্ত অনুদান, বয়স্ক ঢাকিদের জন্য পেনশন ও স্বাস্থ্যসুরক্ষা, এবং ন্যূনতম সম্মানীর আইনি কাঠামো।
দুর্গাপুজো সার্বজনীন হয়েছে, আন্তর্জাতিক মঞ্চে পৌঁছেছে। এখন সময় এসেছে ঢাকিদের মুখেও একটুখানি হাসি ফোটানোর।