– অনিন্দ্যর লেখা
সকালবেলা জানালার কাচে কুয়াশার হালকা চাদর। বাইরে কাকের ডাক, দূরে এক জায়গায় ছেলেপিলের ক্রিকেট আর ঠিক তার মধ্যেই একটানা ট্রামের ঘণ্টির টুংটাং। কলকাতায় একসময় এমন সকাল ছিল অনেকের রোজকার জীবনযাত্রার অংশ। ট্রাম চলত না শুধু রাস্তায়, ট্রাম চলত শহরের ধমনী বেয়ে—বুকে হেঁটে বেড়াত কলকাতা। ট্রামের এই গতি একসময় ঠেলত ঘড়ির কাঁটাকে। স্কুল-কলেজ-পার্লার-বাজার—সব কিছুর সময় গুনে দেওয়া থাকত ট্রামের ‘টাইমিং’ অনুযায়ী।
পাশের সিটে হয়তো বসতেন রেডিও অফিসের দাদা, বা মেডিকেল কলেজের কোনো ‘ইন্টার্ন’।
আর জানালার পাশে দাঁড়িয়ে কেউ একজন চুপি চুপি তার ডায়েরিতে প্রেমের কবিতা লিখে ফেলত—ট্রামের ঝাঁকুনির তালে তাল মিলিয়ে।
ইতিহাস আর চলার গল্প

কলকাতার প্রথম ট্রাম চালু হয়েছিল ১৮৭৩ সালে—ঘোড়ার টানায়।
সেই যাত্রা আজকের দিনে এসে থেমে গেলেও, সময়টা থেমে থাকেনি।
১৯০২ সালে কলকাতায় এলো বিদ্যুৎচালিত ট্রাম, আর তখনই শুরু হয় শহরের সঙ্গে ট্রামের গভীর বন্ধন।
শিয়ালদহ, এসপ্লানেড, ধর্মতলা, গড়িয়া, বেহালা, খিদিরপুর, নাখোদা, মানিকতলা…
যে রাস্তাগুলো আজ যানজটে হাঁপিয়ে ওঠে, সেখানে একদিন ট্রাম চলত ধীরেসুস্থে, শান্তভাবে।
ট্রাম মানেই আড্ডা, প্রেম আর প্রতিবাদ
একটা সময় ট্রাম মানে ছিল আড্ডা।
স্কুল কলেজ ফেরত ছাত্রছাত্রীদের খিলখিল হাসি, পকেটে ৫০ পয়সার টিকিট—আর তাতেই গোটা শহর ঘুরে ফেলা।

ট্রামে প্রেমও হত।
জানালার গায়ে হেলানো চোখ আর সামনের সিটে বসা চুপচাপ ছেলেটির মধ্যে গড়ে উঠত এক নিঃশব্দ আলাপ।
হল না কথা? তবু যেন রোজ একসঙ্গে বাড়ি ফেরা…
আর কখনো কখনো ট্রাম হতো প্রতিবাদের মাধ্যমও।
৭০-এর দশকে কলেজ ছাত্রদের মিছিল থামাত ট্রাম লাইনের উপরে দাঁড়িয়ে। পোস্টার লাগানো হতো জানালার কাঁচে, কনডাক্টরও হয়তো মিছিলে হাঁটতেন একদিন।
একসময় থেমে গেল ট্রাম

যানজট, মেট্রো, সময়ের চাহিদা—সব কিছু মিলিয়ে একসময় শহর হারাতে শুরু করল তার চেনা সুর।
একেক করে বন্ধ হয়ে যেতে লাগলো ট্রাম লাইন।
আজ ধর্মতলা বা খিদিরপুরের কোথাও একটা রেলিংয়ের পাশে পড়ে থাকে পুরনো ট্রামলাইনের কিছু ছেঁড়া অংশ।
আর আমাদের হৃদয়ে রয়ে গেছে সেই টুংটাং আওয়াজটা—যেটা বাজে না এখন, কিন্তু ভুলে যাওয়া যায় না।
কলকাতার হৃদয়ে চিরকাল ট্রাম

ট্রাম হয়তো আজ আর আগের মতো চলে না।
তবু যারা জানে সেই চেনা সিটের কাঠের গন্ধ, জানালায় বইয়ের পাতা ওলটানোর অভ্যেস, কিংবা কনডাক্টরের ঝোলানো টিকিটব্যাগের ঝনঝন শব্দ—তারা জানে, ট্রাম মানে শুধু যাত্রা নয়,
ট্রাম মানে কলকাতার মন।