বিকি সাহা
দ্য ইন্ডিয়ান ক্রনিকলস | কলকাতা, ২৫ জুলাই ২০২৫
আসলে অনেক কিছুই করা যায় , করেন বোধ হয় তিনিই ।
ব্যান্ড এবং আধুনিক গানের মরুঝড়ে তিনি “কীর্তন” গাইলেন এবং একটা প্রজন্ম কে শ্রোতা বানালেন ; তিনি প্রমাণ করলেন কলেজ এর অনুষ্ঠানেও কীর্তন শোনার শ্রোতা কম হয় না ।

২০১৫ , সারেগামাপা র মঞ্চে তিনি গাইলেন কীর্তন অঙ্গের বিভিন্ন গান , এবং সমাদৃত হলেন ঘরে ঘরে , সে দিন কি অদিতি মুন্সি নিজেও জানতেন বিদেশের মাটিতেও তিনি কীর্তন গাইবেন হল ভর্তি লোক এর সামনে ?
সারেগামাপা’র অডিশন দিয়েছিলেন পুরাতনী বাংলা গান গেয়ে , ছোট থেকে মঞ্চেও গেয়েছেন পুরাতনী বাংলা গান । রবীন্দ্রভারতী থেকে বাংলা কীর্তনে স্নাতক এই ছাত্রী , গাইলেন কীর্তন , এবং এই কীর্তন কে করে তুললেন প্রাসঙ্গিক ।

শহর কলকাতার মঞ্চে , কীর্তন পরিবেশন করে শ্রোতা দের বাহবা কুড়িয়ে নেয়ার সাহস বোধকরি সে সময় কেউ দেখাতেন না , যে সময় অদিতি মুন্সী শুধুই কীর্তন গাইবেন বলেই ভাবেন এবং শুধু কীর্তন ই পরিবেশন করলেন শ্রোতাদের , এবং এই কল্লোলিনী তিলোত্তমাও কীর্তন শুনল “হল ভর্তি” করে ।
তিনি নিজেই বারবার ভাঙেন নিজেকে , খুঁজতে বেরিয়ে পড়েন পুরনো কীর্তন , তার ইতিহাস ,আর পুরনো বই আর লেখা । মাটির গানের ইতিহাস খুঁজে মানুষের কাছে নিয়ে আসেন আর বারবার নিজেকেই বোধ হয় নতুন করে তৈরি করেন ; শ্রোতাদের কান কেও । নিজের সামাজিক মাধ্যমে নিজেই জানালেন নতুন কাজের কথা, প্রায় হারিয়ে যাওয়া একজনের গান , রূপচাঁদ পক্ষী। বাংলার ইতিহাস বলে রূপচাঁদ পক্ষীর কথা কিন্তু ব্যবহারিক ক্ষেত্রে কেউ রূপচাঁদ পক্ষী বা তার লেখা নিয়ে শেষ কয়েক বছরে কেউ কাজ করেছেন বলে মনে পরে না । তিনি করলেন , এবং আবারো প্রমান করলেন তিনিই পারেন বোধহয়, এই সময়ে কীর্তন কে , ভক্তিগীতি কে , সকলকে শোনাতে।
“আমারে ফ্রড করে “ ইতিমধ্যে শুনেছেন বহু মানুষ , এবং সমাদৃত হয়েছে অনেকের কাছে ; বাকি গানের চেয়ে অনেকটা অন্যধারার এই গান বাংলার ভীষণ আপন, একান্ত নিজের , কিন্তু ব্যবহার করলেন না কেউই ।
উনবিংশ শতাব্দীর কলকাতার (Kolkata) কথা বলতে বসলে অবধারিত ভাবে রেনেসাঁর কথা ওঠে। আরও কত কী! রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, মাইকেল, রামকৃষ্ণ, সতীদাহ, বিধবা বিবাহ… প্রসঙ্গের তো শেষ নেই। কিন্তু এসবের সঙ্গেই আলোচনায় উঠে আসে বাবুবিলাস ও হুতোমের লেখায় ফুটে থাকা আজব শহরের আশ্চর্য সব চালচিত্র। যার মধ্যে রয়েছে এমন মানুষরাও, যারা পাখি হতে চাইত। হ্যাঁ, অমলকান্তি যেমন রোদ্দুর হতে চাইত, তেমনই ‘মানুষ পাখি’রা দখল করে রেখেছিল বাগবাজার, বটতলা ও বউবাজার। আর এই পাখিদের রাজা ছিলেন রূপচাঁদ পক্ষী। বদলে যাওয়া শহর কি মনে রেখেছে সেদিনের পক্ষীরাজকে? বদলে যাওয়া শহর কে একটু পুরোনো ইতিহাসের দলিলে মুড়ে দিলে ক্ষতি কি ? অদিতি মুন্সীও কি তাই একটু নস্টালজিয়া উস্কে দিলেন? নাকি নিঃশব্দে বোঝালেন সময় কে সামনে রেখে ইতিহাস ভুলে যাবার প্রবনতার মাঝে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন, এবং বাংলার এই ঘরানা হারিয়ে যেতে তিনি দেবেন না ।

কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্যের পরবর্তীতে এই মাটির গানে ইতিহাসের খোঁজ কেউ করেন নি একথা ঠিক নয়, কিন্তু এটা ঠিক অদিতি মুন্সীই একমাত্র শিল্পী যিনি শুধু কীর্তন এবং ভক্তিগীতি গেয়েছেন, গাইছেন ,শহর কলকাতা থেকে বহুদূরে কখনো অস্ট্রেলিয়া কখনো আমেরিকার মাটিতে, এই সাহসের পরিচয় সমসাময়িক কেউ দিয়ে উঠলেন না বা সাহস করলেন না।

তিনি চিরকালই এরম বোধহয় , নিনের সামাজিক মাধ্যমে গান আর পরিবার ছাড়া কোনোদিন কিছু লেখেন নি , কোনো বিতর্ক তাকে আলো দেয় না উল্টে বিতর্কের আলো থেকে অনেকটা দূরে থেকে শুধু গানেই জীবন কে যাপন করেন এই শিল্পী , গান আর গানের ইতিহাস -এই নিয়ে দিব্যি আছেন। ‘অন্তরে অতৃপ্তি রবে, সাঙ্গ করি মনে হবে, শেষ হইয়াও হইল না শেষ’। ছোটগল্প নিয়ে লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই লাইন বোধ হয় সত্যি প্রাসঙ্গিকতা পায় বার বার, নইলে সাহিত্য ইতিহাস থেকে একটু দূরে থাকা শিল্পীদের ভিড়ে একটা অদিতি মুন্সী বারবার নিজেকে ভেঙে নতুন কিছু থুড়ি পুরোনো কিছুকে উপস্থাপিত করতেন না , এই ভাবে ।