পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি মানুষ কথা বলেন চিনা ভাষায়। সেই তালিকায় ৬ নম্বরে আছে বাংলা। ফরাসি, রাশিয়ান, পর্তুগিজের মত ভাষা যেগুলির বিস্তার বিপুল, বিশ্বের বহু দেশের মানুষ যে ভাষাগুলিতে কথা বলে সেগুলোও বাংলার থেকে পিছিয়ে। বর্তমান বিশ্বে প্রায় ২৮ কোটি মানুষের মাতৃভাষা বাংলা। তবু বাংলা বিপন্ন!
ব্যাঙ্গ নয়। সত্যিই বাংলা ভাষা, বাঙালি বিপন্ন। যত দিন যাচ্ছে তার এই বিপন্নতা একটু একটু করে বাড়ছে। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি মানুষ যে ভাষায় কথা বলে সেই চিনা ভাষার এক অদ্ভুত সুবিধে আছে। চিন দেশের প্রায় সকলেরই মাতৃভাষা এই চিনা বা মান্দারিন। ফলে এই ভাষায় কথা বলা মানুষ অন্যান্য দেশে তেমন একটা না থাকলেও সমস্যা নেই। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যার দেশ চিন। ফলে তার অভ্যন্তরীণ বাজার বিশাল। অন্য কোথাও কদর না পেলেও নিজের অভ্যন্তরীণ বাজারের জোরে চিনা ভাষার অস্তিত্ব নিয়ে বিশেষ একটা প্রশ্ন ওঠার কথা নয়।
ভাষা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে এই যে বাজারে প্রসঙ্গ চলে এল তাতে গোটা বিষয়টা একটু গুলিয়ে যেতে পারে। কিন্তু বাস্তব হল, কোনও ভাষা তখনই সফলভাবে অস্তিত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয় যখন বাজারে তার দর থাকে। অর্থাৎ, কেবলমাত্র সেই ভাষাটি জানলেও আপনার জীবিকা নির্বাহে কোনরকম সমস্যা হবে না, এই শর্তই একটি ভাষাকে ভালোভাবে বাঁচিয়ে রাখতে পারে। চিনা ভাষা চিনের মানুষকে ঠিক সেই সুবিধেটা করে দেয়।
এই তালিকা দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে থাকা স্প্যানিশ ও ইংরেজি ভাষাও এই সমস্ত ভাষাভাষী মানুষদের সেই করে খাওয়ার সুবিধেটা দেয়। যদি স্প্যানিশ ভাষার কথায় আসা যায়, সেক্ষেত্রে দেখা যাবে একসময় স্পেন লাতিন আমেরিকার বিস্তীর্ণ এলাকায় উপনিবেশ গড়ে তোলার দৌলতে পৃথিবীর বহু দেশের প্রধান ভাষা বর্তমানে স্প্যানিশ। তাৎপর্যপূর্ণভাবে এই দেশগুলির বেশিরভাগই সরকারি কাজকর্ম স্প্যানিশেই সারে। প্রয়োজনে দোভাষী ব্যবহার করে, তবু মাতৃভাষার বাইরে গিয়ে খুব কম কথা বলে। ফলে এই সমস্ত দেশের বাজারে লেনদেন, চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত কাজে শুধুমাত্র স্প্যানিশ ভাষাটা ভালো করে জানলেই অংশগ্রহণ করা সম্ভব।
ইংরেজির বিষয়টি আবার সবকিছুর থেকেই আলাদা। এই ভাষার মূল আঁতুড় ঘর ইংল্যান্ডের থেকে বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তে অনেক বেশি মানুষের মাতৃভাষা ইংরেজি। তার থেকেও ইংরেজি ভাষার বড় সুবিধা হল, বহু অন্য ভাষাভাষী প্রধান দেশও অফিশিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ বা কাজের ভাষা হিসেবে ইংরেজিকে স্বীকৃতি দিয়েছে। যেমন, আমাদের ভারত। আফ্রিকা ও এশিয়ার বহু দেশের প্রধান চারটে ভাষার মধ্যে ইংরেজি না এলেও সেখানে কাজের ভাষা হিসেবে ইংরেজি প্রাধান্য পেয়ে থাকে। ফলে ইংরেজি যার মাতৃভাষা তার গোটা বিশ্বজুড়ে কাজের কোনও অভাব হওয়ার কথা নয়। অন্তত ভাষাজনিত দক্ষতার অভাবে কাজ যাওয়াটা কিছুটা অস্বাভাবিকই হবে।
তথ্য বলছে পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম ভাষা হল হিন্দি। প্রায় ৩৮ কোটি মানুষের মাতৃভাষা এটি। এবং মূলত ভারতের জনগণই এই ভাষায় কথা বলে। ভুল, স্রেফ উত্তর ভারতের একটা বড় অংশের মাতৃভাষা হিন্দি। কিন্তু আমরা বাস্তবে কী দেখি? আমাদের দেখা এবং বাস্তব অভিজ্ঞতা হল, শুধুমাত্র হিন্দি জানলেই মোটামুটি ভারতজুড়ে কাজ করা সম্ভব। এর কারণ ভারতের শাসকদের দেশের সংবিধানকে অমান্য করে বাকি অংশের উপর হিন্দ-কে চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা। তাই কেন্দ্রীয় সরকারের যে কোনও চাকরিতে ইংরেজির পাশাপাশি শুধুমাত্র হিন্দিতেই পরীক্ষা দেওয়া যায়। অন্য কোনও ভাষার মানুষকে এই একই কাজের জন্য নিজের মাতৃভাষার পাশাপাশি ইংরেজিটাও অত্যন্ত ভালোভাবে শিখতে হয়। কিন্তু হিন্দী ভাষাভাষী ছেলেমেয়েদের নিজেদের ভাষার বাইরে অন্য কোন ভাষা না শিখলেও চলে যায়। বরং এই সুযোগে তারা মূল বিষয়গুলি আরও রপ্ত করার উপর জোর দিতে পারে। সম্ভবত এই কারণেই ভারতবর্ষের উচ্চপদস্থ সব সরকারি চাকরিতে হিন্দি ভাষাভাষীদের দাপট অপরিসীম।
এই তালিকায় হিন্দির পরেই আছে বাংলা। তার বিস্তার মোটেও ফরাসি (ফ্রেঞ্চ), স্প্যানিশ, পর্তুগিজ, ইংরেজি মত বিপুল নয়। কিন্তু সমগ্র বাংলাদেশের প্রায় ৯৯% শতাংশ মানুষের মাতৃভাষা এটি। পশ্চিমবঙ্গের ৯০% মানুষের মাতৃভাষা এটি। ত্রিপুরার প্রধান ভাষা এই বাংলা। এছাড়াও মেঘালয়, অসম, ঝাড়খণ্ডে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাঙালির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। তবু বিপন্ন বাংলা ভাষা।
স্প্যানিশ, ইংরেজি, পর্তুগিজ, ফ্রেঞ্চ-র মত সুবিধা নেই। হিন্দির আধিপত্যবাদ আছে। এগুলো বাংলা ভাষার কোণঠাসা হওয়ার কিছুটা কারণ হতে পারে, তবে মূল নয়। বাংলা ভাষার বিপন্ন হওয়ার মূল কারণ- বাঙালিই আর বাঙালি নেই!
কথাটা শুনতে খুব অদ্ভুত লাগলেও বাস্তব হল, দুই বাংলার বাঙালি একে অপরকে আজ মুসলমান ও হিন্দু পরিচয়ে চেনে। বাঙালি বলে তারা কেউ কাউকে স্বীকৃতি দিতেই কার্যত রাজি নয়! পশ্চিমবঙ্গের গড়পড়তা বাঙালি বোঝে, বাংলাদেশ একটি মুসলমান রাষ্ট্র। ওরা আমার থেকে আলাদা। বাংলাদেশের বাঙালি আবার বোঝে, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ আসলেই হিন্দু। ওদের থেকে আমার সংস্কৃতি অনেক আলাদা!
এই বোঝাপড়ায় কি খুব ভুল আছে? না। সত্যিই তো বাংলা ভাষার জন্য দেশটির জন্ম হলেও পরবর্তীতে বাংলাদেশ ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে। সে তার ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র সঠিকভাবে বজায় রাখতে পারেনি। বাংলায় কথা বললে, লিখলেও বহু বাংলাদেশি নিজেকে বাঙালির বদলে মুসলমান হিসেবে ভাবতে অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এমনকি বাংলায় কথা বললেও প্রয়োজন ছাড়াই উর্দু ও আরবির প্রতি তাঁদের মনের মধ্যে এক অপরিসীম প্রেম লালিত হয়।
পশ্চিমবঙ্গের ছবিটাও খুব অন্যরকম নয়। এখানে এখনও একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নিজেদের ধর্মীয় পরিচয়ের উর্ধ্বে উঠে বাঙালি হিসেবেই ভাবতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। কিন্তু আমজনতার বড় অংশ সানন্দে নিজের মাতৃভাষাকে বিসর্জন দিয়ে দিয়েছে স্রেফ হিন্দু ও মুসলমান পরিচয়কে বড় করে তুলে ধরার জন্য। যারা হিন্দু পরিচয় নিয়ে গর্বিত, তাঁদের কাছে ধীরে ধীরে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছে হিন্দি। পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে বাঙালির থেকে মুসলমান পরিচয় যাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তাঁরা ক্রমশই আরবির ফাঁদে জড়িয়ে পড়ছেন।
এর ফলে যতদিন যাচ্ছে ততই নতুন প্রজন্ম বাংলা ভাষা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। অভিভাবকদের কারণেই তাদের মধ্যে বাঙালি সত্ত্বা বলে খুব একটা কিছু ছোট থেকেই গড়ে উঠছে না। এই পরিস্থিতিটা সবচেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর পশ্চিমবঙ্গে। মূলত ইংরেজিকে আশ্রয় করে বেড়ে উঠছে নতুন প্রজন্ম এবং তারপর অপশন হিসেবে বেছে নিচ্ছে হিন্দিকে। বাঙালির মধ্যেই ঐক্য না থাকায়, সে নিজেকে বাঙালি হিসেবে মনে না করায় আরও সঙ্কুচিত হচ্ছে বাংলা ভাষার বাজার। বাংলার সংস্কৃতি, শিল্পচর্চা ক্রমশ কোণঠাসা হওয়ায় শুধু বাংলা ভাষা জেনে আয় করার সুযোগ আর কিছুদিনের মধ্যে বোধহয় পুরোপুরিই বন্ধ হয়ে যাবে। কী লাভ বাংলা শিখে?
এই পরিস্থিতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় অভিভাবকরা প্রশ্ন তুলছেন, কেন আমার সন্তানকে বাংলা শিখিয়ে সময় অপচয় করব! ঠিক। সবার আগে করে খেতে হবে তো। আর তার পরবর্তী স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় এই পশ্চিমবঙ্গের বুকে ব্যবসা করা স্কুল বাংলা শিক্ষিকাকে টাটা গুডবাই করে দিচ্ছে। এটা আসলে হওয়ারই ছিল। এমন বহু হয়। অনেকদিন ধরেই হচ্ছে। তবে সবগুলি ঘটনা প্রকাশ্যে আসে না বলে এর আগে এতটা হইচই হয়নি।
তবে কি বাংলা ভাষাকে বাঁচানোর কোনও পথ নেই? পথ আছে। তার জন্য ধর্মীয় চেতনাকে প্রচ্ছন্ন রেখে তামিল ভাষাভাষী মানুষের মত নিজেদের আগে বাঙালি হিসেবে ভাবতে শিখতে হবে। গর্ব অনুভব করতে হবে বাঙালি পরিচয়ে। এক্ষেত্রে একটা জিনিস মাথায় রাখার, অন্য ভাষার প্রতি সঙ্কীর্ণতাবাদ দিয়ে এই পরিস্থিতি সামলানো যাবে না। তা থেকে দু-চারজন রাজনৈতিক ফায়দা পেতে পারেন, কিন্তু বাঙালির, বাংলা ভাষার লাভের লাভ কিছু হবে না। বরং মুসলমান পরিচয়ের আগে বাঙালি এবং হিন্দু পরিচয়ের আগে বাঙালি পরিচয় প্রদান হয়ে উঠলেই এই কার্যসিদ্ধি সম্ভব।
সেইসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে জরুরি হল প্রতিটি স্কুলে বাংলা ভাষা পড়ানো বাধ্যতামূলক করা। বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলিতে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে আইন করে বাংলা পড়ানোকে বাধ্যতামূলক করতে হবে রাজ্য সরকারকে। একমাত্র তবেই বাংলা ভাষা বাঁচবে। আর একটা জিনিস মাথায় রাখবেন, বাজার বড় বালাই। কোনও একটি ভাষা শিখে আপনি যদি করে খেতে না পারেন তবে অন্যদিকে ঝুঁকে পড়তে বাধ্য!