শরৎ এলেই বাংলার বাতাসে ভেসে আসে ঢাকের ডাক, কাশফুলের হাসি আর দেবীপক্ষের চিরন্তন টান। কিন্তু এই উৎসব কি কেবল ভক্তির? কেবল চোখধাঁধানো প্রতিমা আর আলোর রোশনাই? ইতিহাস বলছে, না। দুর্গাপূজা ছিল রাজনীতির মঞ্চ, শক্তির কৌশল, আর লোকবিশ্বাসে গাঁথা প্রতীকী প্রতিবাদের ভাষা।

আজও যখন আমরা সাবেকি জমিদার বাড়ির পূজোর প্রতিমার দিকে তাকাই, তার শোভা আর আড়ম্বর দেখে মুগ্ধ হই, তখন হয়তো আমরা ভুলে যাই—এই শোভা কেবল দেবীর আরাধনা নয়, ছিল রাজনৈতিক চাল, জমিদারি প্রতিষ্ঠা আর একধরনের ‘soft power’।
রাজাদের পুজো: দেবীকে নয়, খুশি করতে সাহেবদের?
১৭শ-১৮শ শতকে বাংলায় যখন জমিদার ও রাজপরিবারগুলি নিজেদের জমিদারি রক্ষার লড়াইয়ে ব্যস্ত, তখন তারা বুঝেছিলেন—দেবীর কৃপা চাই, কিন্তু দরকার ইংরেজদের অনুগ্রহও। দুর্গাপূজা হয়ে উঠল সেই সেতুবন্ধন।

রাজাদের উদ্দেশ্য ছিল দ্বিমুখী—দেবীর কাছে আশীর্বাদ চাওয়া, আর ইংরেজ সাহেবদের আতিথেয়তায় মুগ্ধ করা। সাহেবরা আসতেন, খেতেন, মদ খেতেন, নাটক দেখতেন—আর জমিদার পেতেন রাজনৈতিক সুরক্ষা।
সেই সঙ্গে চলত জমিদারদের মধ্যে এক অনুচ্চারিত প্রতিযোগিতা—“কার পুজো বড়?”
প্রতিমার উচ্চতা, বাজনার আওয়াজ, অতিথির গাড়ির সংখ্যা—সব ছিল রাজকীয় প্রতাপের হিসেব।
তাই দুর্গাপুজো ছিল এক অনন্য চাতুর্য—ধর্ম ও রাজনীতির সূক্ষ্ম মিশ্রণ।
‘মহিষাসুরের কপালে ঘা’ – প্রতাপ নয়, প্রতিরোধ
পুজোর শেষ লগ্নে, নবমী বা দশমীর দিন অনেক জায়গায় দেখা যায় এক আশ্চর্য রীতি—মহিষাসুরের কপালে দা, কাঠ বা লোহার দণ্ড দিয়ে ফাটল তৈরি করা হয়।
যদিও এটি অনেকের চোখে নিছক লোকাচার, আসলে এই আচারে লুকিয়ে আছে গভীর দার্শনিকতা।

পুরাণ বলে, দেবী দুর্গা ত্রিশূল দিয়ে মহিষাসুরের কপালে বিদ্ধ করে তাঁর বিনাশ করেন। আর লোকবিশ্বাসে, এই ফাটল না থাকলে বছরজুড়ে অশান্তি আসে ঘরে।
তবে কপাল কেন? কপাল মানে চেতনা—অহংকার, লালসা, পাপ—সব যে বোধের গভীরে বাস করে, সেই চেতনাতেই আঘাত হানা হয়। এ যেন অজ্ঞতার মূলে তীব্র প্রতিবাদ।
আরেক দিক থেকে দেখলে, এই আঘাত একপ্রকার ‘শেষ ঘা’, যেখানে দেবীর সঙ্গে আমজনতাও অংশ নেয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে জয়যাত্রায়।
রাজাদের দুর্গাপূজা একদিকে ছিল আত্মরক্ষার পূজা—দেবীর কৃপা ও সাহেবদের কৃপায় জমিদারি টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা।
অন্যদিকে, মহিষাসুরের কপালে আঘাত ছিল প্রতীকীভাবে পাপ, অহংকার ও অজ্ঞতার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের মৌন প্রতিবাদ।
আজ আমরা যখন ‘মহালয়া’ শুনে আবেগে ভাসি, কিংবা ঠাকুর দেখতে গিয়ে চোখ মেলে তাকাই রাজবাড়ির সাবেকি পূজোর দিকে, তখন ভাবি না—এই উৎসবের প্রতিটি স্তম্ভ দাঁড়িয়ে আছে রাজনীতি, প্রতিবাদ আর লোকবিশ্বাসের অনন্ত সমীকরণে।