অনিন্দ্যর লেখা –
“বুঝলে ভাই, গঙ্গাজলে বিষ মিশিয়ে দিলেও বাঙালি খাবে, যদি বলে এটা পুরনো রেসিপি!” — এই কথাটা হালকা মজা হলেও বাঙালির মদ্যপান বা ‘সুরা’প্রেমের একটা গভীর ঐতিহাসিক চেহারা তুলে ধরে। আজ আমরা দাঁড়িয়ে ২০২৫ সালে, কন্টেম্পোরারি ককটেল, হ্যান্ডক্রাফটেড বিয়ার, আর হিপস্টার বার কালচারের যুগে। প্রশ্ন হল, বাঙালির মধ্যে সুরা-প্রেম কি নতুন করে বেড়েছে, না পুরনো যুগের মতোই আছে – শুধু মোড়কটা বদলেছে? —
ঐতিহাসিক পটভূমি:

শৌখিন রাজা থেকে গলির কবি সুরা কোনো সময়েই বাঙালির কাছে ট্যাবু ছিল না। প্রাচীন বঙ্গ সাহিত্যে ‘মদ্য’ বা ‘মদিরা’ নিয়ে বিস্তর উল্লেখ আছে। চর্যাপদেও কিছু লাইন ব্যাখ্যা করা হয় সুরাপান বা ‘তান্ত্রিক’ আচার হিসেবে। নবাবি আমলে ও ব্রিটিশ শাসনে কলকাতায় ‘সুরাপান’ ছিল অভিজাত ও সাহেব সংস্কৃতির প্রতীক। সেই ধারা বাংলা সিনেমায় এসেছে ‘Old Monk’ হাতে বসে থাকা কবি, বিপ্লবী কিংবা দুঃখবিলাসী নায়কের মাধ্যমে। উল্লেখযোগ্য, হিন্দু কলেজের যুগে বিদ্যাসাগর, দীনবন্ধু মিত্রদের ছাত্রাবস্থায় চা-চক্র যেমন ছিল, তেমনি ছিল সুরা-আলোচনা। গোপনে, লজ্জায়, অথচ নিবিড় টানে।
আধুনিক শহুরে কালচার: বেড়েছে সুরা, না বদলেছে রুচি?

গত এক দশকে বাঙালির পান করার ধরনে এসেছে বৈচিত্র্য। এখন শুধুমাত্র ‘দারু’ খাওয়া নয়, সেটা কী ব্র্যান্ডের, কোন গ্লাসে, কোন গান চলছে, সেই অভিজ্ঞতাটাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কলকাতা শহরে এখন ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের মধ্যে যে পান-সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, তা অনেকাংশে ‘সোশ্যাল ড্রিঙ্কিং’-এর দিকে। উইকেন্ড মানেই মাইক্রো-ব্রুয়ারিতে আড্ডা, রুফটপ বারে বার্থডে, বা হাউস পার্টিতে হুইস্কি সেশন। তবে এখানেই একটা বিভাজন স্পষ্ট—আগে যেখানে মধ্যবিত্ত সমাজে সুরা মানে ছিল ‘লুকিয়ে খাওয়া’, এখন সেটা হয়ে উঠছে ‘স্টাইল স্টেটমেন্ট’।
নস্টালজিয়া বনাম নতুন যুগ: কে কাকে টপকাল?

পুরনো দিনে ‘খাসি আর ওল্ড মঙ্ক’ ছিল একটা ঘরোয়া রীতি। কোনও দাদা অফিস থেকে ফেরার পর সিগারেটের সঙ্গে খেতেন “ভদকা এক পেগ”—এটা ছিল বাস্তবতা। এখনকার প্রজন্মের হাতে এক্সপেনসিভ গিন, ককটেল শেকার, আর ইনস্টাগ্রাম স্টোরি। তবে একটি বিষয় বদলায়নি—আড্ডা ও সম্পর্কের সাথে মিশে থাকা সেই নেশার ঘ্রাণ। আগে সেটা ছিল নিঃশব্দ অভ্যাস, এখন সেটা ক্যামেরাবন্দী স্মৃতি।
তথ্যচিত্র ও সমীক্ষার ছায়া:

একটি বেসরকারি সমীক্ষা অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে গত পাঁচ বছরে আলকোহলের উপর মাথাপিছু খরচ ২২% বেড়েছে। এর মধ্যে ৪৮% হল ২০ থেকে ৩৫ বছর বয়সীদের। এই পরিবর্তন অনেকটাই কোভিড পরবর্তী স্ট্রেস, একাকীত্ব, ও ডিজিটাল লাইফস্টাইলের দিক থেকে বিশ্লেষণযোগ্য।
বাঙালির সুরা-প্রেম কোনো দিনই কম ছিল না, বরং রূপান্তরিত হয়েছে সময়ের সঙ্গে। ‘কান্তার কাব্য’ থেকে ‘ককটেল কালচার’—বাঙালি সব যুগেই নেশাকে নিয়েছে এক ধরনের রসাস্বাদন হিসেবে। হয়তো নতুন মোড়কে পুরনো সেই নেশাটাই ফিরে আসছে, আরও আধুনিক, আরও খোলামেলা ভাবে।