এক সময়ের জনসমুদ্র এখন শুধুই স্মৃতি। চড়কের মেলার কাঁঠালচাপা গন্ধ, ঝাঁপ দেওয়া সন্ন্যাসী, আর রঙিন হুল্লোড় যেন হারিয়ে যাচ্ছে কর্পোরেট উৎসবের ধাতব কোলাহলে।
প্রারম্ভিক অনুচ্ছেদ:

চৈত্র সংক্রান্তি আর পয়লা বৈশাখ—বাঙালির ক্যালেন্ডারে একসময় ছিল দুটি আবেগঘন দিন। গ্রামবাংলার হৃদয়ে ছিল চড়কের মেলা, সন্ন্যাসীর ঝাঁপ, আর খোলা মাঠের প্রাণবন্ত উৎসব। কিন্তু আজ? শহুরে বাঙালির চোখ এখন ধনতেরাস, একের পর এক EMI, আর সস্তায় ‘ফ্ল্যাট 50%’ অফারের দিকেই।
চড়কের মেলার ঐতিহ্য:

চড়কের মেলা কেবল একটি ধর্মীয় বা লোকাচারিক অনুষ্ঠান নয়, এটি ছিল একটি সামাজিক মিলনমেলা। সন্ন্যাসীদের ত্যাগ ও যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে বছরের শেষ দিনে পাপমোচনের বার্তা বয়ে আনত এই উৎসব। সঙ্গে থাকত হস্তশিল্পের দোকান, নাগরদোলা, পটের গান, ঝাঁপের মঞ্চ—একটা ভরপুর সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা।
আজকের প্রজন্ম কী হারাচ্ছে?

চড়কের মেলায় গিয়েছেন এমন অনেক তরুণই আজ আর খুঁজে পান না কাছাকাছি কোনো আয়োজন। গ্রামেগঞ্জে কোথাও কোথাও এখনও কিছু আয়োজন থাকে বটে, তবে তার আকার অনেকটাই সংকুচিত। ঢাক-ঢোলের জায়গায় এসেছে ডিজে, গামছা-কাপড়ের হাটকে সরিয়ে দিয়েছে ব্র্যান্ডেড কর্নার।
ধনতেরাসের আগমন এবং শহুরে উৎসববোধের পরিবর্তন:

গত দশকে ধনতেরাসের প্রচলন বাঙালি সমাজে ব্যাপকভাবে বেড়েছে। সোনার গয়না, ইলেকট্রনিকস বা গাড়ি কেনার ‘শুভ সময়’ হিসেবে ধনতেরাসের প্রচারণা ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে বিজ্ঞাপন ও সোশ্যাল মিডিয়ার হাত ধরে। নববর্ষ মানেই এখন পাঞ্জাবি-সেলফি-রেস্তোরাঁর রিজার্ভেশন, অথচ প্রকৃত বাংলার ছোঁয়া যেন হারিয়ে যাচ্ছে।
বিশ্লেষণ: কেন এই পরিবর্তন?
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পরিবর্তনের মূলে রয়েছে জীবনের গতি ও মিডিয়া-নির্ভর সংস্কৃতির জোয়ার। ‘লোক-উৎসব’ যেখানে অংশগ্রহণমূলক, সেখানে ধনতেরাস একটি ভোক্তাবাদী উৎসব। চড়কের মেলায় যাওয়া মানে ছিল একটি দিন কাটানো, কিন্তু ধনতেরাস মানে ৫ মিনিটের অনলাইন শপিং—কম সময়ে বেশি তৃপ্তি।
চড়কের ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনা আছে?
স্থানীয় প্রশাসন এবং সংস্কৃতি অনুরাগীরা চেষ্টা করছেন চড়কের মেলার পুনরুজ্জীবনের। কয়েকটি জেলা চৈত্রসংক্রান্তিকে ঘিরে আবারও আয়োজন শুরু করেছে। তবে সেটা সফল করতে হলে প্রয়োজন সাংস্কৃতিক জাগরণ, তরুণ প্রজন্মের অংশগ্রহণ এবং মিডিয়ার সহায়তা।
উপসংহার:
চড়কের মেলা কেবল একটি উৎসব নয়, এটি ছিল বাংলার প্রাণের স্পন্দন। বাঙালি যতদিন নিজস্ব সংস্কৃতি ভুলে যাবে, ততদিন আমাদের এই রঙিন ঐতিহ্যরা এক এক করে হারিয়ে যাবে ইতিহাসের পাতায়। এখনো সময় আছে—চলুন চড়কের হাত ধরে ফিরি মাটির গন্ধে ভেজা শিকড়ে।