ঈশ্বর কি কেবল ব্রাহ্মণদের? শাস্ত্র ও ইতিহাস বলছে — না, ঈশ্বরের কথা বলার অধিকার সবারই আছে
একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে এখনও কি কোনও মানুষ ঈশ্বরের কথা বলার জন্য জাতি দেখে শাস্তি পেতে পারেন? উত্তরপ্রদেশের ইটাওয়ার কাছে দাঁদরপুর গ্রামে সম্প্রতি যা ঘটেছে, তা শুধু হৃদয়বিদারকই নয়, আমাদের ধর্মীয় মূল্যবোধের পক্ষে এক গভীর ধাক্কা।
মুকুট মণি যাদব নামে এক অ-ব্রাহ্মণ কাহিনীকার এবং তাঁর সঙ্গীদের উপর ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ঈশ্বরের কথা বলার “অপরাধে” হামলা চালানো হয়। কেটে নেওয়া হয় টিকি, ঢেলে দেওয়া হয় গোমূত্র, বলা হয় — তিনি অশুচি। অথচ প্রশ্ন ওঠে — ঈশ্বরের কথা বলা কি কোনও জাতির একচেটিয়া অধিকার?

শাস্ত্র কী বলছে?
ভারতীয় ধর্মীয় সাহিত্য ও দর্শনের কেন্দ্রে আছে দুই মহাকাব্য — রামায়ণ ও মহাভারত। রামায়ণের রচয়িতা বাল্মীকি ছিলেন শূদ্র। মহাভারতের রচয়িতা বেদব্যাস মৎস্যজীবিনী ঘরের সন্তান। পুরাণের অন্যতম শ্রোতা সূতজী-ও ব্রাহ্মণ ছিলেন না। এই মহান ব্যক্তিরা জাতিতে নয়, জ্ঞানে, সাধনায় ও ভক্তিতে পূর্ণ ছিলেন।
মহাভারতে যুধিষ্ঠির বলেছেন —
“যদি কোনও শূদ্র সত্য ও সদগুণ ধারণ করেন এবং কোনও ব্রাহ্মণ না করেন, তবে সেই শূদ্র শূদ্র নয়, সেই ব্রাহ্মণও ব্রাহ্মণ নয়।”
ব্রাহ্মণত্ব কোনও জন্মগত তকমা নয়, তা আসে আচরণ, জ্ঞান ও নৈতিকতা থেকে।

ইতিহাস কী শেখায়?
ভক্তি আন্দোলনের মূল প্রবর্তকরা ছিলেন মূলত নিম্নবর্ণের। রামানন্দ, কবীর, নামদেব, তুকারাম, সেন, রৈদাস — এঁরা কেউই ব্রাহ্মণ ছিলেন না। তাঁদের ভক্তি ও ঈশ্বর প্রেম আজও ভারতীয় ধর্মীয় সংস্কৃতির মেরুদণ্ড।
বিশিষ্টাদ্বৈত দর্শনের প্রবক্তা রামানুজাচার্য এক হাজার বছর আগেই মন্দিরের দরজা সকল জাতির মানুষের জন্য খুলে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন —
“ব্রাহ্মণ্যত্ব জন্মে নয়, আচরণে নির্ধারিত হয়।”
তিনি শূদ্রদের কাঁধ ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন মন্দিরে স্নানে, ভাঙতে চেয়েছিলেন অহংকারের প্রাচীর।
তাঁর বিখ্যাত ঘোষণা —
“আমার নরক যাওয়া মেনে নেব, যদি তাতে হাজারো মানুষের মুক্তি হয়” — আজও সমান প্রাসঙ্গিক।

জাতপাত বনাম ভক্তি
ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পর্ক জন্মসূত্রে নয়, অনুভব ও উপলব্ধির মাধ্যমে গড়ে ওঠে। ভক্তি হল আত্মার আহ্বান — তা কোনও ধর্ম, জাত বা বর্ণে বাঁধা পড়ে না। বৈষ্ণব শাস্ত্রে ৬৪ ধরনের অপরাধের মধ্যে অন্যতম হল ‘ভক্তদের মধ্যে ভেদাভেদ করা’।
তুলসীদাস লিখেছিলেন —
“ধূর্ত বল, রজপুত বল, জোলাহা বল — আমি কেবল রামের দাস।”
সত্যিকারের ভক্ত সেই, যার মনে প্রেম আছে, কথায় ভক্তি আছে, এবং কর্মে মানবতা।
সমাজের বার্তা
আজও যদি কেউ মনে করেন ঈশ্বর কেবল ব্রাহ্মণদের বিষয়, তবে তিনি শাস্ত্র, ইতিহাস ও ধর্ম — তিনটির সঙ্গেই বিশ্বাসঘাতকতা করছেন। সমাজে বিভাজন এনে ধর্ম নয়, অধর্মই চর্চা হয়।
আসুন, বিভেদের নয়, ভক্তির ভাষায় কথা বলি। জাতি নয়, কর্ম ও চরিত্র হোক মানদণ্ড।