The Indian Chronicles-এর জন্য বিশেষ নিবন্ধ – কলকাতা নস্টালজিয়া
অনিন্দ্যর লেখা –
একটা সময় ছিল, যখন হাওড়া স্টেশনে ট্রেন ধরার আগে লোকজন শুধু বোর্ডিং পাশ খুঁজতো না — খুঁজতো একটা চটি বই। নামটা শুনলেই গালভরা হাসি আসে, কিন্তু এই “চটি” শব্দের পেছনে লুকিয়ে ছিল একটা সমান্তরাল সাহিত্যজগত। তাতে মিশে থাকতো রহস্য, যৌনতা, নিষিদ্ধতা আর এক অদ্ভুত কৌতূহল।
চটি গল্প তখন শুধু বিনোদনের উপকরণ ছিল না — সেটা ছিল এক রকম সমাজচিত্র, নীরব কামনা আর স্বপ্নমিশ্রিত একটি গোপন দুনিয়া।

“চটি” শব্দটা এসেছে কোথা থেকে?
‘চটি’ শব্দের মানে ছোট, অর্থাৎ ছোট সাইজের, পাতলা, কম দামে ছাপা বই।
কিন্তু তার ভিতরে যা থাকতো তা একেবারে তেজস্ক্রিয় — এমন কিছু গল্প, যা প্রকাশ্যে পড়তে লজ্জা হলেও, লুকিয়ে লুকিয়ে সবাই পড়তো।
জেমস হ্যাডলি চেজ-এর বাংলা অনুবাদ, হালকা প্রেমের গল্প, রোমাঞ্চ, কখনও পর্নোগ্রাফির সীমারেখা ছুঁয়ে যাওয়া ভাষা — সবই ছিল এই ঘরানায়।

হাওড়া স্টেশন: চটির রাজধানী
ট্রেন ছাড়ার ২০ মিনিট আগে আপনি প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে — এক হাতে গরম চা, অন্য হাতে ‘রাতের শহরের গোপন কাহিনি’ টাইপের একটা বই।
হাওড়া স্টেশনের বুক স্টলগুলো ছিল এই সাহিত্যের উৎসকেন্দ্র।
Minerva, M.P. Stores, A.K. Book Stall — একাধিক নামকরা দোকানে আপনি পেতেন এই বইগুলো।
স্টলে দাঁড়িয়ে কেউ হঠাৎ বলতো, “ভাই, ‘রতি রহস্য’ আছে?”
দোকানদার চোখে চোখ রেখে বলতো, “সামনের বইটা দেখুন, আর একটা স্পেশাল আছে ব্যাগে।”
এ এক চোরাগোপ্তা ব্যবসা, অথচ পুরো শহর জানতো — কে কিসের খোঁজে এসেছে।

কিসের গল্প থাকতো?
রাতের কলকাতা, মাসাজ পার্লারের অন্তরজগৎ, হোটেল কক্ষে বিপজ্জনক রাত, ট্যাক্সিচালকের অভিজ্ঞতা, শিক্ষিকার গোপন জীবনের কাহিনি, নতুন বউয়ের ডায়েরি
এমনকি কিছু লেখক বাস্তব অপরাধকেও ব্যবহার করতেন কল্পনার রঙে।
এই গল্পগুলো ভাষাগতভাবে সহজ, আকর্ষণীয়, আর প্রায়শই ‘লো-লিটারেচার’ ট্যাগে ফেলা হলেও — তারা একেবারে জনমানসের রগরগে অভ্যন্তরে গেঁথে বসে থাকতো।

লেখক কারা ছিলেন?
বেশিরভাগ লেখক ছদ্মনামে লিখতেন —
সুদীপ্তা সেনগুপ্ত, মিঠুন ব্যানার্জী, ডি. কে. সরকার — এমন সব নাম, যাদের আপনি জীবনে খুঁজে পাবেন না, কিন্তু বইয়ের নাম দেখলেই চিনে ফেলবেন।
অনেকেই ছিলেন পত্রিকা অফিসের সাব-এডিটর, কেউ আবার কলেজের বাংলা বিভাগের অবজ্ঞাত শিক্ষক।

হারিয়ে যাওয়ার ইতিহাস
নব্বইয়ের দশকে ভিসিআর, পর্নসিনেমা আর ইন্টারনেট আসতেই চটির দুনিয়া ধাক্কা খায়।
স্টেশন স্টলগুলো বদলে যায় — জায়গা নেয় সিডি, রিচার্জ কুপন, বিদেশি ম্যাগাজিন।
আজও হয়তো কোনো পুরনো দোকানের এক কোণে ধুলোপড়া অবস্থায় একটা বই শুয়ে আছে – “কালো বউয়ের রহস্য”।
চটি: লজ্জা নয়, ইতিহাস
আমরা যতই একে “অশ্লীল সাহিত্য” বলে দূরে রাখি, সত্যিটা হলো – এই গল্পগুলোই এক সময় সাধারণ মানুষের সবচেয়ে কাছে পৌঁছে যাওয়া গল্প ছিল।
যেখানে প্রেম, কাম, ভয়, কৌতূহল — সব একসাথে খেলে যেতো ২৪ পাতার মধ্যে।
চটি ছিল সমাজের সেই দিকটা, যা আমরা মুখে স্বীকার করি না, কিন্তু চুপিচুপি জানি।
আজকের ই-বুক, রিলস, ওয়েবসিরিজের যুগে হয়তো কেউ আর ট্রেন ধরার আগে বই কেনে না।
তবু, হাওড়া স্টেশনের সেই দিনের কথা মনে পড়লে, চোখে ভাসে এক যুবক – ব্যাগে ‘চটি’, মনে কল্পনার ঢেউ, আর পেছনে পেছনে একটা নীল বিকেলের গন্ধ।