গল্পে মোড়া এক দোকানের বিদায়—‘দেশবন্ধু মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’ এখন শুধু স্মৃতি
হাওড়া ব্রিজ থেকে নামলেই বাম পাশে তাকালেই দেখা মিলত এক পুরনো হলুদ বাড়ির। একতলার বারান্দায় নীল রঙা সাইনবোর্ডে বড়ো বড়ো করে লেখা—‘দেশবন্ধু মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’। সকাল হলেই আশেপাশের রাস্তাঘাট গন্ধে ম ম করে উঠত—ঘিয়ের গন্ধে ভাজা কচুরি, সীতাভোগ, মিহিদানা, সন্দেশের সেই মোহময়ী আহ্বান যেন রোজকার শহুরে ক্লান্তির মাঝে ছিল এক চুমুক প্রশান্তি।

শুধু পেটই নয়, মনও ভরিয়ে দিত এই দোকান। অথচ, আজ সেই দোকানের ঝাঁপে ঝুলছে এক বিরাট তালা।
চুপিচুপি বিদায় নিয়েছে কলকাতার মিষ্টির ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অধ্যায়।
এক শতাব্দীর যাত্রা শুরু হয়েছিল বর্ধমান থেকে
১৯২১ সাল। বর্ধমান শহরের চাকরি ছেড়ে কলকাতায় এলেন বিভূতিভূষণ চৌধুরী। সঙ্গে আনলেন বর্ধমানের গর্ব—সীতাভোগ ও মিহিদানা। কেবল মিষ্টির স্বাদই নয়, বর্ধমানের দক্ষ ময়রাদেরও নিয়ে এলেন তিলোত্তমায়। লক্ষ্য ছিল একটাই—কলকাতাকে ভোলাতে হবে বর্ধমানের স্বাদে।

কম সময়েই ছড়িয়ে পড়ল খবর। এম.জি. রোডের বাসচালক থেকে শুরু করে অফিসযাত্রী, সকালের জলখাবারে ছিল একটাই গন্তব্য—দেশবন্ধু। হিঙে মেশানো ঘিয়ে ভাজা কচুরি, ছোলার ডাল, আর তারপর এক গুলাব জামুন—দিনটাই যেন জমে যেত।
নামকরণেও ছিল দেশপ্রেমের ছোঁয়া
শোনা যায়, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস একদিন মিহিদানা খেয়ে আপ্লুত হয়ে পড়েন। সেদিনই দোকানটির নাম হয়ে যায় ‘দেশবন্ধু’।
তাঁর সঙ্গে ছিল এক নিবিড় বন্ধুত্ব মালিক বিভূতিভূষণের। পরবর্তীতে দোকানের আড্ডায় যোগ দেন কৃষ্ণচন্দ্র দে, পঙ্কজ কুমার মল্লিক, দাদাঠাকুর ও পদ্মজা নাইডুর মতো কিংবদন্তিরা।



এ ছিল এক অন্যরকম সময়—যেখানে মিষ্টি শুধু খাবার ছিল না, ছিল স্মৃতি, গল্প, সংস্কৃতি।
ব্যবসার নিয়মেও ছিল মজা
‘ফেলো কড়ি মাখো তেল’—এই স্লোগান মেনেই দোকানে মিষ্টি বাছাই করে তারপর কাউন্টারে গিয়ে কুপন কেটে তবেই মিলত কাঙ্ক্ষিত রসনার রসদ। সেসব কুপনের দামের পাশে কাগজের স্তর জমেছে বটে, কিন্তু সাইনবোর্ড বদলায়নি একবারও।

দোকানের শেষ ম্যানেজার মিহির বিট একবার বলেছিলেন, “উৎসবের মরশুমে ভিড় সামলাতে হিমশিম খেতে হতো। পুজো, বিয়েবাড়ি মানেই দেশবন্ধুর মিষ্টি। কারোর মুখের হাসি, কেউ বা মনোরঞ্জন—সব কিছুতেই জড়িয়ে ছিল আমাদের মিষ্টি।”
তালা পড়ল, কিন্তু স্মৃতি কোথায় আটকে রাখা যায়?
করোনাকালের ধাক্কা, লোকসান, আর উত্তরসূরীদের অনীহায় থেমে গেল এক শতাব্দীর চলমান ইতিহাস।
শাটার আজ বন্ধ, ভেতরে আর নেই ছানার গন্ধ বা কচুরির ছ্যাঁকা। সাইনবোর্ডটাও নাকি উঠে গেছে।

তবু যারা একবার ‘দেশবন্ধু’-র ঘিয়ের স্বাদ পেয়েছেন, তাঁদের মন থেকে মুছে যাওয়া কি সহজ?
তিলোত্তমা হারাল তার এক অতুলনীয় স্বাদ-চিহ্ন, আর আমরা হারালাম একটা ইতিহাস।
কলকাতার ব্যস্ত রাস্তায় এবার আর পাওয়া যাবে না সেই পরিচিত গন্ধটা।
‘দেশবন্ধু মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’-এর গল্পটা তাই আজ শুধুই নস্টালজিয়ার খাতায় লেখা এক অমলিন অধ্যায়।
স্মৃতির পাতায় থাকুক সে জ্বলজ্বলে রয়ে, গলে যাক না সময়ের স্রোতে… মিহিদানার মতো!