✍️ The Indian Chronicles
দুর্গাপুজো মানেই আবেগ। ঢাক, ধুনো, নতুন জামা, ভোগের গন্ধে ম ম করা দুপুর, সন্ধ্যায় মণ্ডপে মণ্ডপে ঘোরা — এই সব মিলিয়ে পুজো বাঙালির হৃদয়ে গাঁথা এক চিরন্তন অনুভূতি। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই আবেগ-ভিত্তিক উৎসব হয়ে উঠেছে এক বিশাল অর্থনৈতিক ইঞ্জিন।
আজ পুজো শুধু ‘ধর্মীয় উৎসব’ নয় — এটি একটি বৃহৎ শিল্পক্ষেত্র, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে কোটি টাকার ব্যবসা এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবিকা।

🎯 পুজোর টাকার অঙ্কে ওজন
একটা সময় দুর্গাপুজো ছিল মূলত পারিবারিক বা স্থানীয় আয়োজন। এখন তা এক গ্ল্যামার ও থিম-ভিত্তিক বিশাল আয়োজন। কলকাতা শহরে প্রতি বছর প্রায় ২,৫০০-৩,০০০টি মণ্ডপ হয়, এবং প্রত্যেকটির বাজেট গড়ে ২০-৫০ লক্ষ টাকা, আবার বড় বড় পুজো কমিটির বাজেট ২-৫ কোটি টাকা পর্যন্ত পৌঁছে যায়।

২০২৩ সালের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, শুধুমাত্র কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় পুজোকে কেন্দ্র করে মোট অর্থনৈতিক লেনদেনের পরিমাণ ছিল প্রায় ৭,০০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে রয়েছে—
মণ্ডপ নির্মাণ ও প্রতিমা গঠন
থিম আর্ট ও আলোকসজ্জা
হোর্ডিং ও ব্র্যান্ড প্রমোশন
খাবার ও ক্যাটারিং পরিষেবা
ফ্যাশন ও রিটেল সেলস
হোটেল, অ্যাপ ক্যাব, পর্যটন
ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ও ডিজিটাল কভারেজ
💼 কতজনের জীবিকা পুজোর উপর নির্ভরশীল?
দুর্গাপুজোতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় বহুমাত্রিক স্তরে। পুজোর কয়েক মাস আগে থেকেই কুমোরটুলিতে মৃৎশিল্পীরা মূর্তি গড়ায় ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। বাঁশ-মাটি-রঙ দিয়ে প্রতিমা বানানো থেকে শুরু করে বিশাল মণ্ডপ গড়ার পেছনে কাজ করেন হাজার হাজার কারিগর।
প্রায় ৩ লক্ষেরও বেশি মানুষ সরাসরি বা পরোক্ষভাবে দুর্গাপুজোর অর্থনৈতিক চক্রের অংশ হন —
প্রতিমাশিল্পী ও চিত্রকর
ইলেকট্রিক ও লাইটিং টেকনিশিয়ান
ঢাকি ও সঙ্গীতশিল্পী
ক্যাটারিং ও হকার
হোর্ডিং ও প্রিন্ট মিডিয়া কর্মী
গার্মেন্টস ও রিটেল বিক্রেতা
ক্যাব/ট্যাক্সি ড্রাইভার
ইউটিউবার ও কনটেন্ট ক্রিয়েটর
এই উৎসবের আয় থেকেই বহু ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী তাদের বছরের সঞ্চয় গড়ে তোলেন। পুজো যেন তাদের জন্য এক মৌসুমি কর্পোরেট সিজন, যার সফলতা নির্ধারণ করে পরবর্তী বছরের আর্থিক স্থিতি।

📈 ব্র্যান্ডিং ও মার্কেটিংয়ের অন্যতম ক্ষেত্র
বড় বড় কর্পোরেট হাউস ও FMCG কোম্পানিগুলি এখন দুর্গাপুজোকেই তাদের ব্র্যান্ড প্রচারের প্রধান মঞ্চ হিসেবে বেছে নিচ্ছে। হোর্ডিং, স্পনসরশিপ, ডিজিটাল ক্যাম্পেইন, ইনফ্লুয়েন্সার মার্কেটিং — সবই ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে পুজোর সময়টাকে কেন্দ্র করে।
একটি সুনির্দিষ্ট তথ্য অনুযায়ী, শুধুমাত্র হোর্ডিং-ভিত্তিক বিজ্ঞাপন থেকেই কলকাতা কর্পোরেশন ও বিজ্ঞাপন সংস্থাগুলি ২০০-৩০০ কোটি টাকা পর্যন্ত আয় করে এই সময়ে।

🌍 পর্যটন ও আন্তর্জাতিক গুরুত্ব
পুজোর সময়ে কলকাতা হয়ে ওঠে আন্তর্জাতিক পর্যটকদের গন্তব্যস্থল। দুর্গাপুজোর সৌন্দর্য ও সংস্কৃতির টানে বহু বিদেশি পর্যটক প্রতি বছর কলকাতায় আসেন। হোটেল, রেস্তরাঁ, লোকাল ট্রান্সপোর্ট, গাইড সার্ভিস, হ্যান্ডিক্রাফ্ট — সবখানেই অর্থ প্রবাহ ঘটে।
২০২১ সালে UNESCO দুর্গাপুজোকে Intangible Cultural Heritage of Humanity হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, যা এই উৎসবকে বিশ্বব্যাপী একটি ব্র্যান্ডে পরিণত করেছে। ফলে এখন রাজ্য সরকারও দুর্গাপুজোকে ঘিরে “বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস” মডেল গড়ে তুলতে শুরু করেছে।
🔚আবেগের সঙ্গে বাস্তবতা
দুর্গাপুজো আজও আবেগ, ঐতিহ্য আর চেতনার উৎসব — কিন্তু সেই আবেগ আজ বহু মানুষের জীবিকা, বহু শিল্পের অস্তিত্ব এবং এক রাজ্যের অর্থনীতির চালিকাশক্তি।
এই কারণে বলা যেতেই পারে —
“পুজো এখন শুধু আবেগ নয়, এক প্রকৃত ইকোনমিক ইঞ্জিন।”