অনিন্দ্যর লেখা-
একটা সময় ছিল, যখন সন্ধ্যা নামলেই বউবাজারের নির্জন অলি-গলিতে ঢুকে পড়ত সেতার, তবলা আর গজলের আওয়াজ। শহরের অভিজাত বাবু, জমিদার আর বিলেতফেরত সাহেবরা ছুটে আসতেন সেই অলীক জগতে — যাকে আমরা বলি ‘বাইজিপাড়া’। আজ যেখানে কলেজ স্ট্রিটের কোলাহল, বউবাজার স্ট্রিটের হাড়জিরজিরে বাড়ি আর বাইক-অটো-বাসের ধোঁয়া, একদিন ঠিক সেখানেই ছিল কলকাতার আর এক ‘রাত্রিকথা’।
বাইজি মানে কেবল নৃত্যগীত নয়

বাইজি বলতে আমরা অনেকেই ভুল করে যাই, ভাবি যেন তারা শুধু নর্তকী বা গায়িকা। কিন্তু বাস্তবে, বাইজিরা ছিলেন সময়ের সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞান। ওস্তাদদের কাছে তালিম নেওয়া, উর্দু-ফারসি কবিতা, ঠুমরি-দাদরা থেকে শুরু করে রাগদারিতে পারদর্শী একেকজন শিল্পী।
বউবাজারের গলিগুলো হয়ে উঠেছিল সেসব ‘মেহফিল’-এর আস্তানা।
একটা সময়, নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ কলকাতায় এসে বাইজিদের পৃষ্ঠপোষকতা করায় ব্যাপক প্রসার ঘটে এই সংস্কৃতির।
গলি নয়, যেন এক মঞ্চ

খুব বিখ্যাত ছিলো ‘চাঁদনি চকের বাইজিবাড়ি’, যেটি আজ আর নেই।
জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও নাকি একবার এক বন্ধুর সঙ্গে এক বাইজিবাড়ির পরিবেশনা দেখতে গিয়েছিলেন — যদিও এই তথ্য অনেকটা কিংবদন্তি মাত্র।
বাইজিপাড়ার বাইজিরা অনেক সময় সমাজের উঁচু তলার পুরুষদের প্রেয়সী ছিলেন, কিন্তু তাঁরা কখনোই সমাজে সম্মান পাননি।
অবনমন ও অন্ধকার
স্বাধীনতার পর ধীরে ধীরে বাইজিপাড়ার ঝলমলে রাতেরা ম্লান হতে থাকে। সিনেমা, ক্যাবারে, এবং পরে টেলিভিশনের আগমনে বাইজিদের গান-নাচের গুরুত্ব হারাতে থাকে।
শিল্পীর আসন থেকে তারা নামিয়ে আনা হয় ‘বিক্রয়যোগ্য নারী’-র তকমায়।
সত্তরের দশক থেকে বউবাজারের বাইজিপাড়া পরিণত হয় তথাকথিত ‘রেড লাইট এরিয়া’-তে। মেহফিল হারিয়ে যায়, থেকে যায় শুধু দেহব্যবসার চিহ্ন।
আজকের দিন, ভাঙা হারমোনিয়ামের আওয়াজে

এখনো দু-একটা বাড়িতে পুরোনো হারমোনিয়াম, তবলা আর পুরনো উর্দু গজল লেগে আছে—ধুলো জমে আছে সেই নোটবুকের পাতায়, যেখান থেকে একসময় সুর বের হত।
কেউ কেউ চেষ্টা করছেন এই ইতিহাস ধরে রাখার — যেমন কলকাতার কিছু থিয়েটার গ্রুপ কিংবা গবেষকরা, যাঁরা চান বাইজিদের স্মৃতি শুধু দুঃখগাথা না হয়ে, এক সাংস্কৃতিক দলিল হয়ে উঠুক।
বউবাজারের বাইজিপাড়া আজ অতীত।
কিন্তু যে বাউল, যে ঠুমরি, যে মেহফিল—সেইসব স্মৃতি আজও ভেসে আসে।
একটু কান পাতলে, হয়তো আজও সেই গলির শেষে কেউ গাইছে…
“সাঁওয়ারিয়া তোসে লাগন মোহি লাগি…”