বাঙালির ক্যালেন্ডারে মহালয়া মানেই একটা অদ্ভুত আবেগ। একদিকে যেমন চণ্ডীপাঠে মন হারানো সকাল, অন্যদিকে আজকাল দেখা যায়, অনেক জায়গায় মহালয়ার রাত জেগে বাজি ফাটানো — যেন দুর্গাপুজোর এক “pre-celebration” শুরু হয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু প্রশ্ন হল—এই বাজি পোড়ানোর রীতি কি শাস্ত্রসম্মত? নাকি লোকাচার, লোকবিশ্বাস ও আধুনিক উৎসবচেতনার মিলিত ফসল?

শাস্ত্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি:
শাস্ত্র মতে, মহালয়া মূলত পিতৃপক্ষের অন্তিম দিন। এই দিনে:
- পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে তর্পণ করা হয়।
- গীতায়, গরুড় পুরাণে এবং মনুস্মৃতিতে মহালয়ার গুরুত্ব বলা হয়েছে পিতৃ স্মরণ ও পিণ্ড দানের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি হিসেবে।
- কোনও ধর্মগ্রন্থেই বাজি, আলো, বা আনন্দোৎসবের উল্লেখ নেই।
📖 “তর্পণেন পিতরঃ তুষ্টা ভবন্তি পুত্রস্নেহতঃ” – গরুড় পুরাণ

লোকবিশ্বাস ও বর্তমান প্রেক্ষাপট:
তবে বাঙালির সংস্কৃতিতে শাস্ত্রের বাইরে আরও একটি ধারা রয়েছে—লোকবিশ্বাস ও আবেগের প্রবাহ।
অনেক মানুষ বিশ্বাস করেন:
- এই দিনেই মা দুর্গা কৈলাস থেকে মর্ত্যে আগমন করেন।
- অশুভ শক্তির বিনাশ শুরু হয়।
- বাজি পোড়ানো, আলো জ্বালানো সেই আনন্দ ও শুভ শক্তির আগমনের প্রতীক।
বিশেষ করে পূর্ববঙ্গীয় সংস্কৃতিতে, যেখানে লোকগাথা, পালাগান ও চণ্ডীপাঠের সঙ্গে “ধুনো ও বাজি” মিলেছিল গ্রামীণ পরম্পরায়—সেই রীতিই ক্রমে আধুনিক শহরাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।

আধুনিকতা ও বানিজ্যিকীকরণ:
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে দেখা যাচ্ছে—
- ক্লাব ও পাড়া সংগঠন মহালয়ার রাতেই বাজি ফাটিয়ে দুর্গাপুজোর শুরু ঘোষণা করছে।
- ব্যবসায়িকভাবে বাজি, আলো, সাউন্ড সিস্টেম—সবকিছুর আয়োজন চলছে পূজো পুজোর মতোই জাঁকজমকে।
তবে অনেকেই এটিকে “সংস্কৃতি থেকে বিচ্যুতি” বলে মনে করেন।
তুলনামূলক বিশ্লেষণ:
বিষয় | শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা | লোকবিশ্বাস/আধুনিক রীতি |
---|---|---|
উদ্দেশ্য | পিতৃতর্পণ ও আত্মশুদ্ধি | দেবীপক্ষের শুভ সূচনা |
কার্যকলাপ | প্রার্থনা, পিণ্ডদান | চণ্ডীপাঠ, বাজি পোড়ানো |
আনন্দোৎসব | নয় | হ্যাঁ |
ধর্মগ্রন্থে উল্লেখ | রয়েছে (তর্পণ) | নেই (বাজি-পোড়ানো) |
মহালয়ার রাতে বাজি পোড়ানো হয়তো শাস্ত্রীয় পরম্পরার অংশ নয়, কিন্তু তা লোকসংস্কৃতির একটি বিবর্তিত রূপ। যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে মানুষের অনুভব, বিশ্বাস ও আচারে পরিবর্তন আসে।
তবে মনে রাখা দরকার—এই আনন্দ যেন পরিবেশ ও ধর্মীয় শ্রদ্ধাবোধকে আঘাত না করে।