কলকাতার তরুণ বিতান অধিকারী তাঁর পরিবারকে নিয়ে ভ্রমণে গিয়েছিলেন কাশ্মীরের পাহেলগাঁও-এ। ২২ এপ্রিল, পাক-সমর্থিত জঙ্গিদের অতর্কিত গুলিবর্ষণে তাঁর মৃত্যু ঘটে। তাঁর মৃত্যু শুধুমাত্র একটি পারিবারিক ট্র্যাজেডি নয়, বরং তা গোটা জাতিকে নাড়া দেওয়া এক গভীর প্রশ্ন হয়ে উঠেছে—একজন সাধারণ শিক্ষিত তরুণের জীবন এমন হিংস্রভাবে নিভে যাওয়া আমাদের সমাজ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার উপর এক ভয়াবহ দাগ ফেলে যায়।

এই ঘটনার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়ায় শুরু হয় একটি ক্রাউডফান্ডিং ক্যাম্পেইন, যেখানে ১ কোটিরও বেশি টাকা জমা পড়ে। এক শহুরে, সম্ভাবনাময় তরুণের মৃতদেহ যেন আবেগ-ভিত্তিক নিলামে উঠেছে। অথচ, সীমান্তে নিহত হাজারো সেনা শহীদের পরিবার বহু সময় ধরে অপেক্ষা করেন ন্যূনতম ক্ষতিপূরণের জন্য। বিতানের এই ‘শ্রদ্ধার অর্থবন্যা’ আমাদের সমাজের এক গভীর বৈষম্যকে নগ্ন করে দেয়।
সামাজিক আবেগ না দায়বদ্ধতা?
বিতানের মৃত্যু নিঃসন্দেহে মর্মান্তিক, কিন্তু তার পরের ঘটনায় উঠে আসে আরও বড় প্রশ্ন—আমরা কি আবেগের নামেই দায়িত্ব ভুলে যাচ্ছি? একদিকে সীমান্তে জওয়ানরা প্রাণ হারিয়ে যান প্রতিনিয়ত, তাঁদের পরিবার পায় সামান্য সরকারি সহানুভূতি; অন্যদিকে, সোশ্যাল মিডিয়া যখন কারও মৃত্যুতে ভাইরাল হয়, তখন আবেগের ঢেউয়ে লক্ষ কোটি টাকা ভেসে আসে। তাহলে কি মৃত্যু আজ শ্রেণি, পরিচিতি আর প্ল্যাটফর্ম অনুযায়ী ‘মূল্যায়ন’ পাচ্ছে?
ক্রাউডফান্ডিং না ভাইরাল ইকোনমি?
এই ঘটনা আরও এক গভীর সত্য তুলে ধরেছে—আমরা আজ ভাইরাল আবেগে অর্থ ব্যয় করছি, কিন্তু দায়বদ্ধতার জায়গায় প্রায় শুন্য। বিতানের পরিবারের পাশে দাঁড়ানো অবশ্যই আমাদের মানবিক দায়িত্ব। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এমন হাজারো পরিবার—যাদের সন্তান সীমান্তে শহীদ হয়, বা রাজনৈতিক সহিংসতায় হারিয়ে যায়—তাদের জন্য কি আমরা এমনই সোচ্চার? নাকি সোশ্যাল মিডিয়ার ‘এলগরিদম-চালিত সহানুভূতি’ই এখন দান-সংস্কৃতির একমাত্র ইঞ্জিন?

জাতির বিবেক কোথায় দাঁড়িয়ে?
বিতান ছিলেন প্রতিশ্রুতিশীল, একজন সৃষ্টিশীল ও প্রগতিশীল মননের অধিকারী। তাঁর মৃত্যু এক অপূরণীয় ক্ষতি, এ কথা অস্বীকার করার নয়। কিন্তু এই ঘটনায় আমরা যেমন শোক প্রকাশ করেছি, তেমনি সমাজের একটি পক্ষ যেন সেই শোককে ‘প্রজেক্ট’ করেছে একধরনের আবেগের ক্যাম্পেইনে। এই ক্যাম্পেইন আমাদের মননে প্রশ্ন তোলে—আমরা কি মৃত্যুকে একপ্রকার “বাজারজাত” করছি? শহীদ হওয়া মানে আজ কি ভাইরাল হওয়া?

একটি অসম তুলনা: সেনাদের মৃত্যু বনাম বিতানের জন্য উত্তালতা
একজন সেনা সীমান্তে প্রাণ দিলে তাঁর পরিবার পায় সরকারি ঘোষণার ক্ষতিপূরণ, যা অনেক সময়েই পর্যাপ্ত হয় না। বহু শহীদ পরিবার আজও লড়ছে জমি, চাকরি কিংবা মর্যাদার জন্য। সেখানে বিতানের মৃত্যুর ঘটনায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই কোটি টাকা ছুঁয়ে ফেলা শুধু দান নয়, একধরনের মৌলিক প্রশ্ন: সমাজ কাকে শহীদ মানে? কাকে “দাম” দেয়?
আমরা বিতানের পরিবারের পাশে দাঁড়াবো—এটাই মানবিকতা। কিন্তু আমাদের মানবিকতা যেন সুষম হয়, নির্বাচনী না হয়। সীমান্তে যে সৈনিক শহীদ হন, তাঁর মৃত্যু যেন “মৌন দায়িত্ব” না হয়ে পড়ে। নয়তো আগামী দিনে ভাইরাল হওয়ার ‘যোগ্য’ না হলে, কারও মৃত্যু হয়তো মূল্যহীনই থেকে যাবে। বিতানের মৃত্যু এক বিপর্যয়, কিন্তু তার প্রতিক্রিয়া আমাদের সমাজের বিবেকের অন্ধকার কোণগুলো আলোকিত করে দিয়েছে। এখন সময়, আয়নায় তাকানোর।