“বাড়ির চারদিক দিয়ে জঙ্গল ঘিরে রেখেছে। মেঘলা আকাশ। সেই ঘরে বসে লিখে চলেছেন এক বৃদ্ধ সাহিত্যিক—যার কলমে উঠে এসেছে উদ্বাস্তু বেদনা, মানুষের লড়াই, মাটির গন্ধ। তিনি প্রফুল্ল রায়। আর আজ, সেই কলম চিরতরে থেমে গেল।”

বাংলা সাহিত্যের এক বিশাল অধ্যায় শেষ হল ১৯ জুন, ২০২৫। প্রখ্যাত সাহিত্যিক প্রফুল্ল রায় ৯০ বছর বয়সে পাড়ি দিলেন না-ফেরার দেশে। দীর্ঘদিন ধরেই বার্ধক্যজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন। এদিন সকালে কলকাতায় নিজের বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
🧭 “আমার লেখা শুরু হয়েছিল ছেঁড়া খাতা আর দারিদ্র্য দিয়ে”
১৯৩৪ সালের ১১ সেপ্টেম্বর, তৎকালীন পূর্ববাংলার (বর্তমান বাংলাদেশ) বিক্রমপুরে জন্ম। ছোট থেকেই জীবন দেখে ফেলেছিলেন নানা কঠিন রূপে। দেশভাগের পরে কলকাতায় এসে উদ্বাস্তু জীবনের অনিশ্চয়তার মধ্যেই গড়ে তুলেছিলেন নিজের সাহিত্যভিত্তি।
কোনও প্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্যজগত নয়, বরং মানুষের জীবনের ছোট ছোট গল্প, লড়াই, সম্পর্কের জটিলতা আর বাস্তব অভিজ্ঞতার ওপর ভর করেই গড়ে তুলেছিলেন নিজের লেখনী।
📚 “উদ্বাস্তু জীবন শুধু কষ্ট নয়, লেখার রসদও দেয়”
প্রফুল্ল রায়ের প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয় নাগাল্যান্ডে, তাঁর চাকরিজীবনের সময়ে। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। একে একে এসেছে—

- ‘কেয়াপাতার নৌকো’ – উদ্বাস্তু জীবন ও বঞ্চনার দলিল
- ‘ক্রান্তিকাল’ – পুরস্কৃত উপন্যাস
- ‘চরাচর’, ‘মোহনার দিকে’, ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’ – সাহিত্য থেকে পর্দায় সফল অভিযাত্রা
তিনি লিখেছেন প্রায় ১৫০টিরও বেশি উপন্যাস ও ছোটগল্পগ্রন্থ। তাঁর লেখায় উঠে এসেছে প্রান্তিক মানুষের জীবন, রুজির লড়াই, স্থানচ্যুতি আর সমাজের উপেক্ষিত অধ্যায়।
🎥 লেখার সীমা ছাড়িয়ে গেছেন টেলিভিশনের পর্দাতেও
তাঁর বহু সাহিত্যকর্ম রূপ পেয়েছে টেলিভিশন ও সিনেমায়। ‘কেয়াপাতার নৌকো’-র জনপ্রিয় টিভি ধারাবাহিক থেকে শুরু করে ‘চরাচর’-এর মতো চলচ্চিত্র বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের পরিচালনায় আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রশংসিত হয়েছে।
এক কথায়, প্রফুল্ল রায় ছিলেন সেই বিরল লেখক, যাঁর সাহিত্য শুধু পড়ার নয়, দেখারও।
🏅 সাহিত্যজগতে স্বীকৃতি
প্রফুল্ল রায় সাহিত্যকে শুধু সমৃদ্ধ করেননি, সাহিত্য তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছে যোগ্য সম্মান। পেয়েছেন—
- সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার (২০০৩ সালে ‘ক্রান্তিকাল’ উপন্যাসের জন্য)
- বঙ্কিমচন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার
- মতিলাল পুরস্কার
- ভুয়ালকা পুরস্কার
তাঁর লেখায় বারবার ফিরে এসেছে বাংলা তথা ভারতীয় সমাজের পরিবর্তনের ছাপ।
🕯️ “যিনি চলে গেলেন, রেখে গেলেন তাঁর ছায়া”
প্রফুল্ল রায়ের মৃত্যুতে একাধিক বিশিষ্ট সাহিত্যিক, নাট্যকার, অভিনেতা, সাংবাদিক ও পাঠকমহল গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। সাহিত্যপ্রেমীদের কথায়, “তিনি ছিলেন মানুষের লেখক। যাঁর প্রতিটি শব্দের পেছনে ছিল বাস্তবের রক্তমাংস।”
📜 এক পাঠকের জবানিতে
“আমার মা-বাবার উদ্বাস্তু জীবনের গল্প আমি যতটা না তাঁদের মুখে শুনেছি, তার চেয়েও বেশি পেয়েছি ‘কেয়াপাতার নৌকো’ পড়ে। প্রফুল্ল রায় ছিলেন আমাদের পারিবারিক ইতিহাসের নীরব কথক।”
🔚 “কলম থেমেছে, কিন্তু শব্দেরা জেগে থাকবে”
প্রফুল্ল রায়ের মৃত্যুতে বাংলা সাহিত্য হারাল এক গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বরকে। কিন্তু তাঁর লেখনী রয়ে গেল—ভবিষ্যতের পাঠকদের কাছে এক ইতিহাস, এক সত্য, এক সাহসের দলিল হয়ে।
“কেয়াপাতার নৌকো” আজ থেমে গেলেও, তার ঢেউ বাংলা সাহিত্যের পৃষ্ঠায় থেকে যাবে চিরকাল…