বর্ধমানের প্রতাপেশ্বর শিবতলা লেনে এক ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার নিষ্ঠুর পরিণতি
১৯৭০ সালের ১৭ মার্চ পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান শহরের প্রতাপেশ্বর শিবতলা লেন সাক্ষী হয়েছিল এক নৃশংস হত্যাকাণ্ডের। জমিদার ও কংগ্রেসপন্থী সাঁই পরিবারের সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়, যা ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি ভয়াবহ অধ্যায় হয়ে রয়েছে। আজ ৫৫ বছর পরেও সেই হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার পাওয়া যায়নি, যা এখনও এক বিতর্কের বিষয় হয়ে রয়ে গেছে।

কী ঘটেছিল সেদিন?
সাঁই পরিবার বর্ধমানের এক অভিজাত ও প্রভাবশালী পরিবার ছিল, যারা কংগ্রেসের সক্রিয় সমর্থক ছিলেন। অভিযোগ রয়েছে, বর্ধমান জেলায় তখনকার রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে সিপিআই(এম)-এর সমর্থকরা এই পরিবারকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে টার্গেট করে।
সেদিন সকালে একদল দুর্বৃত্ত সাঁইবাড়িতে হামলা চালায়। তারা প্রণব সাঁই এবং মলয় সাঁইকে নির্মমভাবে হত্যা করে, এমনকি গৃহশিক্ষক জিতেন রায়কেও রেহাই দেওয়া হয়নি। পরিবারের নারীদের চোখের সামনে তরুণদের কচুকাটা করা হয়। নিহতদের গরম ভাতের সঙ্গে রক্ত মিশিয়ে মা এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের খেতে বাধ্য করা হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।

রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ও তৎকালীন পরিস্থিতি
এই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, এবং তাৎক্ষণিকভাবে কংগ্রেস নেতৃত্ব ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নিজে সাঁইবাড়িতে এসে নিহতদের পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা দেন এবং এই হত্যাকাণ্ডের কঠোর বিচার চেয়েছিলেন।
তৎকালীন সময়ে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস এবং সিপিআই(এম)-এর মধ্যে রাজনৈতিক সংঘর্ষ তীব্র আকার ধারণ করেছিল। একদিকে কংগ্রেস জমিদারশ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করছিল, অন্যদিকে সিপিআই(এম) কৃষক এবং শ্রমিকদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। এর মধ্যেই রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বলি হয়েছিল সাঁই পরিবার।

বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা ও বিতর্ক
এই হত্যাকাণ্ডের বিচার নিয়ে একাধিক তদন্ত কমিশন গঠিত হয়, কিন্তু বিচারপ্রক্রিয়া বিভিন্ন রাজনৈতিক কারণে দীর্ঘায়িত হতে থাকে।
১৯৭০ সালের ২৮ এপ্রিল বিচারপতি তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করা হয়। তবে সাঁই পরিবার এই তদন্তের ফলাফলে সন্তুষ্ট ছিল না।
২০১১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস সরকার পুনরায় তদন্ত শুরু করে। বিচারপতি অরুণাভ বসুর নেতৃত্বে নতুন কমিশন গঠন করা হলেও, সেই রিপোর্ট আজও প্রকাশ করা হয়নি।
অভিযুক্তদের মধ্যে অনেকেই পরবর্তীতে উচ্চপদস্থ রাজনৈতিক নেতা হয়ে ওঠেন এবং বিচারের হাত থেকে বেঁচে যান। অনেকেই বৃদ্ধ বয়সে মারা গেছেন, ফলে আইনি বিচারের পথ আরও জটিল হয়ে উঠেছে।

৫৫ বছর পরেও ন্যায়বিচারের অপেক্ষা
আজও সাঁইবাড়ি গণহত্যার শহীদদের স্মরণে প্রতি বছর ১৭ মার্চ বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। প্রথমে কংগ্রেস এই স্মরণসভার আয়োজন করলেও, পরবর্তীতে তৃণমূল কংগ্রেস এই দায়িত্ব নেয়।
সাঁই পরিবারের বর্তমান সদস্যরা এখনও এই হত্যাকাণ্ডের সুবিচার চান, কিন্তু এত বছর পরও তারা আশাহত। রাজনৈতিক দলগুলোর পালাবদল ঘটলেও, ন্যায়বিচার অধরা থেকে গেছে।
সাঁইবাড়ি গণহত্যা কি শুধুই ইতিহাস, নাকি বিচার হবে?
সাঁইবাড়ি হত্যাকাণ্ড শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গের নয়, পুরো ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অন্ধকার অধ্যায়। প্রশ্ন থেকে যায়—এখনও কি সেই শহীদদের আত্মার শান্তি মিলবে? রাজনৈতিক ফায়দার বাইরে গিয়ে কি সত্যিকারের বিচার সম্ভব?
এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো ভবিষ্যতের হাতেই রয়েছে। কিন্তু ইতিহাস কখনও ভুলে না—সাঁইবাড়ি হত্যাকাণ্ড সেই চিরন্তন সত্যের এক নির্মম উদাহরণ।