মহালয়ার ‘জাগো, তুমি জাগো’— যার কণ্ঠে প্রথম শুনেছিল বাঙালি, সেই বিস্মৃত গায়ক সত্য চৌধুরী
এই মহালয়ায় আসুন, নতুন প্রজন্মকে জানাই সেই সুরস্রষ্টার কথা— যাঁর কণ্ঠ ছিল মহালয়ার প্রথম জাগরণে…
The Indian Chronicles – ইতিহাস, সঙ্গীত ও স্মৃতির সন্ধানে।
বর্তমানের ডিজিটাল জীবনযাত্রায় স্মার্টফোন, ওটিটি প্ল্যাটফর্ম আর অ্যাপ-সিরিজ আধিপত্য বিস্তার করলেও, মহালয়ার ভোরে ঠিকই ফিরে আসে সেই আদি সুর— “আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জীর…”। আর এই অমোঘ আবহের এক অন্যতম স্তম্ভ হয়ে আছেন সত্য চৌধুরী। যাঁর কণ্ঠেই প্রথম ধ্বনিত হয়েছিল ‘জাগো, তুমি জাগো’।
কে ছিলেন সত্য চৌধুরী?

১৯১৮ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর, কলকাতার গ্রে স্ট্রিটে জন্মগ্রহণ করেন সত্য চৌধুরী। পিতা যতীন্দ্রমোহন চৌধুরী ছিলেন উচ্চ আদালতের আইনজীবী। তাঁদের আদি নিবাস ছিল অবিভক্ত বাংলাদেশের রাজশাহীতে। ছোটবেলা থেকেই সঙ্গীতের প্রতি গভীর অনুরাগ ছিল তাঁর। ছাত্রাবস্থাতেই জিতে নিয়েছিলেন একাধিক সঙ্গীত প্রতিযোগিতা।
রবীন্দ্রসঙ্গীত থেকে শুরু করে কীর্তন, নজরুলগীতি, দেশাত্মবোধক গান— সবেতেই ছিল সমান দখল। তাঁর কণ্ঠের বিশেষত্ব ছিল নাটকীয়তা ও আবেগের অসামান্য প্রকাশ।

মহালয়ার ‘জাগো’ গান ও সত্য চৌধুরীর অবদান
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চিরায়ত বর্ণনা, বাণীকুমার-পঙ্কজ মল্লিকের যুগ্ম সৃষ্টিতে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’— এই আকাশবাণীর অনুষ্ঠান মহালয়ার চিরন্তন প্রতীক হয়ে উঠেছে। কিন্তু এই অনুষ্ঠানে ‘জাগো, তুমি জাগো’ গানটি সর্বপ্রথম গেয়েছিলেন সত্য চৌধুরী। তাঁর উদাত্ত কণ্ঠ ও গায়কির গুণে গানটি ছড়িয়ে পড়ে বাঙালির হৃদয়ে।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও পরে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় এই গানটি গাইলেও, সত্য চৌধুরীর আসল অবদান বহু ক্ষেত্রেই আজ বিস্মৃত।
বাংলা ও হিন্দি সঙ্গীতে অবদান
সত্য চৌধুরীর রেকর্ড করা গানগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘পৃথিবী আমারে চায়’, ‘জেগে আছি একা’, ‘নয়ন ভরা জল গো তোমার’। বাংলা ছাড়াও হিন্দি ও উর্দু গানে অসাধারণ পারফরম্যান্স করেছেন। ‘দুনিয়া বুলা রহে’ গানটির মাধ্যমে সর্বভারতীয় খ্যাতিও অর্জন করেন। আকাশবাণীর বহু অনুষ্ঠানে তাঁর গান ছিল প্রধান আকর্ষণ।

শিল্পীর অভিমান
১৯৫৫ সালের পরে সত্য চৌধুরীর রেকর্ডে আর গান নেই। কেন? হয়তো গানের বিবর্তনের প্রতি এক অভিমান, হয়তো সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে না পারা। অনেকটা গৌরীকেদার ভট্টাচার্যের মতো তিনিও এক সময় গান ছেড়ে সরে দাঁড়ান।
একটি পরিবার, একটি উত্তরাধিকার
আজও সত্য চৌধুরীর স্মৃতি বয়ে চলেছে তাঁর পরিবার, বিশেষ করে ভ্রাতুষ্পুত্র পরমানন্দ চৌধুরীর নেতৃত্বে। বাঙালির ইতিহাসে যখনই সঙ্গীত নিয়ে আলোচনা হবে, তখন এই শিল্পীর অবদান কখনও অস্বীকার করা যাবে না।
সত্য চৌধুরী: এক বিস্মৃত নায়ক
‘জাগ অনশনবন্দী’ হোক বা ‘তোমার আঁখির মতো’, সত্য চৌধুরীর গায়নে ছিল এক অতল আবেগ। বাংলাদেশে আজও নজরুলগীতির শুদ্ধতার মানদণ্ড হিসেবে ব্যবহৃত হয় তাঁর রেকর্ড। কিন্তু বাংলায়, নিজের ঘরেই, তিনি প্রায় হারিয়ে গেছেন।