(The Indian Chronicles | Kolkata Nostalgia)
অনিন্দ্যর লেখা –
‘সোনাগাছি’ নামটি নিয়ে একাধিক মত রয়েছে। একটি প্রচলিত মত অনুযায়ী, ব্রিটিশ আমলে এখানে একটি বিশাল ‘সোনার গাছ’ ছিল, যার কারণে এলাকার নাম হয় ‘সোনাগাছি’। আবার অন্য এক জনশ্রুতি বলছে, এক ‘সোনা বাই’ নামে বিখ্যাত গণিকাবাড়ির কর্তা এখানে থাকতেন। তাঁর নাম থেকেই এই জায়গার নাম হয় ‘সোনাগাছি’।

ঔপনিবেশিক কলকাতায় যৌনপল্লীর জন্ম
১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পর ব্রিটিশরা যখন কলকাতাকে রাজধানী হিসাবে গড়ে তোলে, তখন সৈনিক ও ব্যবসায়ীদের “বিনোদনের” প্রয়োজন মেটাতে কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় গণিকাদের আনাগোনা বাড়ে। শুরুতে এরা থাকতেন লালবাজার, চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউর ধারে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসন চেয়েছিল এই ব্যবসাকে একটা ‘নির্দিষ্ট জায়গায়’ সীমাবদ্ধ করতে।
তখনই ধীরে ধীরে একত্রিত করা হয় এই পেশার মানুষদের — এবং গড়ে ওঠে সোনাগাছি যৌনপল্লী, যা ধীরে ধীরে ভারতের অন্যতম বৃহত্তম নিষিদ্ধ পল্লীতে রূপ নেয়।
-1598373209.png?w=undefined&auto=format%2Ccompress&fit=max)
আধুনিক সোনাগাছির জন্ম: ১৯শ শতকে
সোনাগাছির আধুনিক রূপ গড়ে ওঠে ১৮০০ সালের পর থেকে। কলকাতা তখন ব্রিটিশ ভারতের বাণিজ্যিক কেন্দ্র, আর এই শহরের অভিজাত সমাজে ‘বাইজি সংস্কৃতি’ তখন চূড়ান্ত জনপ্রিয়। অনেক গণিকা তখন শুধুই দেহ বিক্রি করতেন না, বরং গানে, নাচে, সাহিত্যে পারদর্শী ছিলেন। তাঁদের ঘরে যেতেন জমিদার, ইংরেজ সাহেব, এমনকি লেখকরাও।

ব্রিটিশ আইন ও পুলিসের ভূমিকা
ব্রিটিশ শাসনামলে ‘Prostitution’ অবৈধ ছিল না। তবে যৌনপল্লিগুলোর উপর নজরদারি ছিল প্রশাসনের। একসময় পুলিশ এই পল্লীর নিয়ন্ত্রণ নিলেও দুর্নীতি, দালাল চক্র ও অপরাধে জড়িয়ে পড়ে এই এলাকা।

নারীর জীবনের অস্পষ্ট রূপরেখা
সোনাগাছি আজ শুধু একটি যৌনপল্লী নয়, বরং এটি হাজার হাজার মেয়ের, তাঁদের সন্তানদের, তাঁদের পরিবারহীন জীবনের গল্প। অনেক নারী চাইলেও এই পেশা থেকে বের হতে পারেন না। আবার অনেকে নিজের সন্তানকে এই অন্ধকার ভবিষ্যতের থেকে রক্ষা করতে প্রাণপণে লড়ে যান।

আলোর মুখ – ‘দূর্বার মহিলা সমিতি’
১৯৯২ সালে এই পল্লীতেই গড়ে ওঠে Durbar Mahila Samanwaya Committee, একটি স্বনির্ভর যৌনকর্মী সংগঠন, যারা যৌনকর্মীদের অধিকার, স্বাস্থ্য এবং মর্যাদার জন্য কাজ করে চলেছে। এই সংগঠন HIV প্রতিরোধ, নিরাপদ যৌনতার প্রচার এবং যৌনকর্মীদের সামাজিক মর্যাদা নিয়ে কাজ করে। সারা বিশ্বে এই সংগঠন একটি মডেল হিসেবে পরিচিত।

আজকের সোনাগাছি: সংকট, সংগ্রাম আর সম্ভাবনা
বর্তমানে সোনাগাছি প্রায় ১০,০০০-এরও বেশি যৌনকর্মীর বসবাসস্থল। এখানে দালাল চক্রের প্রভাব যেমন আছে, তেমনি নারী নেতৃত্বে গড়ে ওঠা সংগ্রামের ইতিহাসও আছে। সিনেমা, সাহিত্য, নাটকে বারবার উঠে এসেছে এই এলাকা — যেমন “মন্দ মেয়ের উপাখ্যান”, “চোকের বালি” বা “সোনাগাছি” নামেই কিছু ওয়েব সিরিজ।

সোনাগাছি শুধুই যৌনতার গল্প নয়, এটি বেঁচে থাকার গল্প।
সোনাগাছি একদিকে অবৈধ যৌন ব্যবসার কেন্দ্র, কিন্তু অন্যদিকে এটি নারীদের আত্মরক্ষার দুর্গ, যেখানে দুঃখ, নিপীড়ন, বঞ্চনার ভেতরেও জন্ম নেয় প্রতিবাদ, ভালোবাসা আর স্বপ্ন।