অনিন্দ্যর লেখা
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সামাজিক মাধ্যম আমাদের জীবনের এক অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে। এখানে কেউ নিজের গান গায়, কেউ কবিতা বলে, কেউ বা শরীরের সৌন্দর্য নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু সমস্যা শুরু হয় তখনই, যখন এই আত্মপ্রকাশের ধরণ নিয়ে সমাজ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। এক পক্ষ বলে – “এই তো সৃজনশীলতা, স্বাধীনতার প্রকাশ”, আরেক পক্ষ বলে – “এ তো অশ্লীলতা, শালীনতার চরম লঙ্ঘন”।
তাহলে প্রশ্ন উঠছে – কে ঠিক? সমাজ নাকি ব্যক্তি?
প্রথমেই বোঝা দরকার, “অশ্লীলতা” শব্দটির নিজেই কোনও নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। যা একজনের চোখে ‘শিল্প’, তা আরেকজনের চোখে হতে পারে ‘নগ্নতা’। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘চিত্রাঙ্গদা’ নাটকে চিত্রাঙ্গদার আত্মউন্মোচন কি অশ্লীল? না কি তা ছিল এক নারীর আত্মপরিচয়ের যুদ্ধ?
একইভাবে, আজকের দিনে যখন একজন কনটেন্ট ক্রিয়েটর সামাজিক মাধ্যমে শরীরচর্চা, নাচ বা ফ্যাশন প্রদর্শন করে, তা কি সবসময় ‘ভালগার’ বা ‘অপসংস্কৃতি’? নাকি এটা একটা নারীর নিজের শরীরের ওপর নিজের অধিকার দাবি?
তবে হ্যাঁ, বিপরীত পক্ষের কথাও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অনেক সময়ই ক্লিকবেইটের লোভে, ভিউ বাড়ানোর আশায় কনটেন্ট হয়ে পড়ে অনৈতিক এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তখন প্রশ্ন জাগে— এটা কি সত্যিই শিল্পের প্রয়াস, না কি কেবলই পুঁজি অর্জনের এক মাধ্যম?
আর এখানেই আসে ‘সীমা’র প্রশ্ন। কে ঠিক করে সেই সীমা? রাষ্ট্র? সমাজ? নাকি ব্যক্তি নিজেই?
ভারতীয় আইনে তথ্যপ্রযুক্তি আইন (IT Act) এবং ভারতীয় দণ্ডবিধি (IPC)-তে ‘অশ্লীল কনটেন্ট’ শেয়ার করার বিরুদ্ধে ধারা রয়েছে। কিন্তু এসব ধারার প্রয়োগ অনেক সময় হয়ে ওঠে পক্ষপাতদুষ্ট। যেখানে সিনেমার বড়পর্দায় বোল্ড দৃশ্য গ্রহণযোগ্য, সেখানে সামাজিক মাধ্যমে এক স্বাধীন মহিলার সাহসী ছবি অনেক সময় ‘অপরাধ’ হিসেবে গণ্য হয়। এই দ্বিচারিতা কি মেনে নেওয়া যায়?
সমাজ যখন পুরুষের ‘শার্টলেস’ ছবি মজার ছলে নেয়, তখন একজন মহিলার ‘স্পোর্টস ব্রা’ পরে ফিটনেস ভিডিও আপলোড করলে কেন তাকে ‘বেশ্যা’ বলা হয়?
আলোচনা এখানেই শেষ নয়। মিডিয়া, আদালত ও সমাজের সংলগ্ন ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ‘সেন্সরশিপ’ আর ‘সেলফ-রেগুলেশন’-এর মাঝের সুতোটি আমাদেরকেই ব্যালান্স করে টানতে হবে।
সবশেষে, সমাজ যদি খোলামেলা চিন্তার দাবিদার হয়, তবে সৃজনশীলতাকে ‘অশ্লীলতা’ বলে দমন না করে, তাতে গুণগত মান ও উদ্দেশ্য যাচাই করা জরুরি। আর কনটেন্ট ক্রিয়েটরদেরও মনে রাখতে হবে—প্রকাশের স্বাধীনতা যতটা অধিকার, ততটাই দায়িত্বও।
বিতর্ক থাকুক। তর্ক হোক। কিন্তু তাতে যেন শিল্প, নারী এবং স্বাধীনতার গলা না টিপে ধরা হয়।