কলকাতা, ৩০ জুন | The Indian Chronicles ডেস্ক:
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির আকাশে এখন অস্থিরতার ঘনঘটা। কসবার একটি নামী আইন কলেজে এক ছাত্রীকে গণধর্ষণের অভিযোগ ঘিরে রাজ্যজুড়ে নিন্দার ঝড় উঠেছে। প্রশাসনিক স্তরে তদন্ত চলছে পুরোদমে, তবে রাজনৈতিক মহলে এই ঘটনা ঘিরে শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের উপর বহুমুখী চাপ তৈরি হয়েছে।
বাইরে বিজেপির আন্দোলন, অভ্যন্তরে কলহ
ঘটনার পর থেকেই পথে নেমেছে বিরোধী দল বিজেপি। রবিবার গোলপার্ক থেকে গড়িয়াহাট পর্যন্ত মিছিল করেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। আগামী ২ জুলাই কসবা অভিযানের ডাকও দিয়েছেন তিনি। শুধু কলকাতাই নয়, রাজ্যের নানা প্রান্তে বিজেপির মশাল মিছিলের ছবিও উঠে এসেছে।
বিজেপির তরফে এই ঘটনাকে তৃণমূল শাসিত প্রশাসনের ব্যর্থতা বলে দাবি করা হচ্ছে। তাদের বক্তব্য, অপরাধীদের রাজনৈতিক আশ্রয় রয়েছে, আর সেই কারণেই এই ধরনের ভয়ঙ্কর অপরাধ বারবার ঘটছে।
তদন্তের অগ্রগতি: পুলিশ ও সিট সক্রিয়
এই ঘটনায় দ্রুত তদন্তে নামে কলকাতা পুলিশ। গঠন করা হয় বিশেষ তদন্তকারী দল (SIT)। রবিবার অভিযুক্ত ও নির্যাতিতার ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। তার আগে শনিবার রাতেই ঘটনার পুনর্নির্মাণ করে পুলিশ। ক্যাম্পাসে প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে চলে রিকনস্ট্রাকশন।
সূত্র বলছে, তদন্তে নামানো হয়েছে একজন মহিলা সাব ইনস্পেক্টর-সহ চার সদস্যকে। লালবাজার চায়, যাতে নিরপেক্ষ তদন্ত হয় এবং দোষীরা কোনোভাবেই রেহাই না পায়।
জাতীয় মহিলা কমিশনের তৎপরতা
রবিবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন জাতীয় মহিলা কমিশনের সদস্যা অর্চনা মজুমদার। তিনি বলেন, ‘‘নির্যাতিতার বাবার সঙ্গে কথা হয়েছে। পরিবার জানিয়েছে, তারা এই মুহূর্তে সিবিআই তদন্ত চায় না, পুলিশের ওপরই আস্থা রয়েছে।’’
কলকাতা পুলিশের কমিশনার মনোজ বর্মার কাছেও রিপোর্ট তলব করেছে কমিশন। তিন দিনের মধ্যে ঘটনার পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন চেয়েছে তারা।
শাসক দলে অন্তঃকলহ: কল্যাণ বনাম মহুয়া, পাশে মদন
তবে এই প্রশাসনিক চাপের পাশাপাশি শাসক দলের ভেতরেও শুরু হয়েছে চরম বিতর্ক। প্রথমে বিতর্ক তৈরি হয় তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য ঘিরে। তিনি কার্যত ঘটনার গুরুত্বকে হালকা করে ব্যাখ্যা দেন, যা সমালোচনার জন্ম দেয়। এরপর মদন মিত্রের মন্তব্য পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।
তৃণমূলের তরফে জানিয়ে দেওয়া হয়, এই মন্তব্য দুই নেতার ব্যক্তিগত মত, দলের অবস্থান নয়। কিন্তু এতেই ফুঁসে ওঠেন কল্যাণ। সামাজিক মাধ্যমে পাল্টা মন্তব্যে সরব হন তিনি।
এরপর কৃষ্ণনগরের সাংসদ মহুয়া মৈত্র নাম না করে এই দুই নেতার বিরুদ্ধেই তীব্র আক্রমণ করেন। তিনি লেখেন—
“ভারতে নারীবিদ্বেষ রাজনৈতিক গণ্ডি মানে না। কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেসের যে বৈশিষ্ট্য— আমরা এই ধরনের মন্তব্যের বিরুদ্ধে সরব হই, তা সে যেই হোন না কেন।”
এই মন্তব্যে কল্যাণ আরও চটে যান। পাল্টা বলেন—
“আমি সব নারীকেই সম্মান করি, কিন্তু মহুয়া মৈত্রকে ঘৃণা করি। যাঁকে পার্লামেন্টের এথিক্স কমিটি বহিষ্কার করেছে, তাঁকে আমি ঘৃণাই করব।”
লোকসভায় এর আগেও কল্যাণ ও মহুয়ার মধ্যে বিতণ্ডা প্রকাশ্যে এসেছে। তবে এখন পরিস্থিতি ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে শাসক দলের ভাবমূর্তিকে বড়সড় ধাক্কা দিতে পারে বলেই রাজনৈতিক মহলের মত।
রাজনৈতিক বিশ্লেষণ: তৃণমূলের ভাবমূর্তির বড় চ্যালেঞ্জ
একদিকে ধর্ষণ কাণ্ডে অভিযুক্তদের সঙ্গে তৃণমূল যোগের অভিযোগ, অন্যদিকে দলের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে প্রকাশ্য সংঘাত— সব মিলিয়ে চাপে তৃণমূল। এই মুহূর্তে শীর্ষ নেতৃত্বের পক্ষে দলীয় ঐক্য বজায় রাখা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, মহুয়া মৈত্রকে ঘিরে দলের ভেতরে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, তা ভবিষ্যতে আরও বিস্ফোরক রূপ নিতে পারে। তৃণমূলের ভাবমূর্তি রক্ষায় শৃঙ্খলা বজায় রাখা এখন আবশ্যিক।
উপসংহার:
আইন কলেজের ভয়াবহ ঘটনায় রাজ্য প্রশাসন যথাসম্ভব পদক্ষেপ নিচ্ছে, কিন্তু রাজনৈতিক ব্যাকল্যাশ আরও জটিল চেহারা নিচ্ছে। এই মুহূর্তে তৃণমূলের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ— প্রশাসনিক দায় এড়ানো নয়, বরং দলীয় নেতৃত্বের মধ্যকার মনোমালিন্য দ্রুত মিটিয়ে জনমানসে আস্থা ফিরিয়ে আনা।