কলকাতা, ২৪ জুলাই।
একটা শহরের প্রেমিক, একটা জাতির রোমান্সের প্রতীক, আর বাংলা সিনেমার এক জীবন্ত কিংবদন্তি—প্রয়াণ দিবসে দাঁড়িয়ে উত্তম কুমারকে মনে পড়া মানে যেন অন্ধকার হলে বসে শেষ দৃশ্যের ঠিক আগের নিঃশ্বাসটুকু শোনা। আজও বাংলার মানুষ মনে করে, “উনি তো যাবেন না, শুটিংয়ে গিয়েছেন। ফিরে আসবেন… ক্যামেরা ওপেন হলে।”
অভিনয়ের পিছনে অন্য এক মানুষ
উত্তম কুমার নামটা আমাদের কাছে শুধুই ‘নায়ক’ নয়—উনি ছিলেন জীবনের ছায়াছবি। অথচ কজন জানে, জন্মসূত্রে তাঁর নাম ছিল অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায়। ছোটবেলাতেই থিয়েটারে অভিনয়ের টান, কিন্তু জীবনের প্রথম দিকটা ছিল বড়ই সংগ্রামের। পোর্ট কমিশনে ক্লার্কের চাকরি, এরপর সিনেমার প্রতি টান… প্রথম দিককার ছবি একটার পর একটা ব্যর্থ—যেখানে তাঁকে ফ্লপ মাস্টার জেনারেল বলেও কটাক্ষ করা হয়েছিল।
তবুও হাল ছাড়েননি।
‘বসু পরিবার’, ‘সাড়ে চুয়াত্তর’, ‘হারানো সুর’—এই ছবিগুলির পরই বাংলা সিনেমা এক ‘মহানায়ক’কে পায়।

বিমূর্ত এক ভালোবাসা: সুচিত্রা-উত্তম রসায়ন
উত্তম-সুচিত্রা জুটির পর্দার প্রেম তো আমরা সবাই জানি। কিন্তু বাস্তবে?
সুচিত্রা সেনের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়েও বহু গুজব থাকলেও, একান্ত মুহূর্তে উত্তম বলতেন—
“ও আমাকে ভালোবাসত, আমিও ওকে। কিন্তু আমরা জানতাম, সেই ভালোবাসা বাস্তবের জন্য নয়, কেবল পর্দার জন্য।”
সত্যিই তো! এই জুটির মাধুর্য আজও ছাপিয়ে যায় সময়কে।

অজানা এক দিক: রেডিওর উত্তম
একটি বিস্মৃত তথ্য—উত্তম কুমার এক সময় আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের নিয়মিত বক্তা ছিলেন। সিনেমার বাইরেও সাহিত্য পাঠ, গল্প বলায় তাঁর দক্ষতা ছিল অনবদ্য।
তিনি কিশোরদের জন্য ‘রেডিও নাটকে’ কণ্ঠ দিয়েছিলেন—যেখানে তিনি নিজে গল্প লিখতেন, স্ক্রিপ্ট সাজাতেন।
আজ যাঁকে আমরা ‘নায়ক’ হিসেবে জানি, তিনি ছিলেন এক সাহিত্যপ্রেমী লেখক ও কণ্ঠশিল্পীও বটে।
)
উত্তম কুমার ও রাজনীতির টানাপড়েন
কিছু মানুষ জানেন না—১৯৭০ এর দশকে উত্তম কুমারকে রাজনীতিতে টানার চেষ্টা হয়েছিল।
কংগ্রেস ও বামফ্রন্ট—উভয়েই তাঁকে প্রস্তাব দিয়েছিল সাংসদ হওয়ার।
কিন্তু উত্তম কুমারের উত্তর ছিল সোজাসাপ্টা—
“আমি রাজনীতির লোক নই। আমি যদি রাজনীতিতে যাই, পর্দার উত্তম কুমার আর থাকবে না।”

শেষ দৃশ্য: মৃত্যু নয়, ছায়ার মিলন
১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই, সন্ধ্যে ৮টা ৪৫ মিনিট। ‘ওগো বধূ সুন্দরী’-র শুটিং চলাকালীন হঠাৎ বুকে ব্যথা।
অসুস্থ হয়েও বলে গিয়েছিলেন,
“চলো, শেষ সিনটা নিয়ে নিই… ক্যামেরা তো রেডি?”
কিন্তু ক্যামেরা আর অন হয়নি।
হাসপাতালে নেওয়ার পথেই মহানায়ক থেমে গেলেন।
শহর স্তব্ধ হয়ে গেল—কিন্তু তাঁর মৃত্যু হয় না। উনি “কেবল সীনে থেকে ছায়ায় মিশে গিয়েছেন।”
উত্তম কুমার মানে কেবল সিনেমার নায়ক নন, এক চেতনা।
তাঁর হাসি, চোখের দৃষ্টি, সংলাপ বলার ভঙ্গি—সবটাই এক কবিতা।
যেখানে আজও কলকাতা নিজের প্রতিচ্ছবি খোঁজে।
তাঁর প্রয়াণ দিবসে তাই শহর জিজ্ঞেস করে—
“আবার আসবেন না মহানায়ক?”
আর আমাদের উত্তর,
“উনি আছেন… সিনেমার ফিতেতে, হৃদয়ের পর্দায়।”