বহতা নদী সরকার :
জেসিবি। পুরো নাম তাজিমুল হক। চোপড়া কাণ্ডের ন্যক্কারজনক ঘটনার সঙ্গে তৃণমূলের এই নেতা জড়িত। অতীতেও পুলিশের কাছে তার বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। খুন, খুনের চেষ্টা, অপহরণের মতো অভিযোগের মামলায় জড়িয়েছে তার নাম। যুগলকে প্রকাশ্যে নির্যাতন করার অভিযোগ নিয়ে রাজ্যজুড়ে শোরগোলের আবহে সেই সব পুরনো মামলার প্রসঙ্গই উঠে আসতে শুরু করেছে।
রবিবার দুপুরে নির্যাতনের একটি ভিডিয়ো প্রকাশ্যে আসার পর থেকে আলোচনায় উঠে আসে তৃণমূল নেতা জেসিবি। সেই ভিডিয়োতে দেখা যায়- প্রকাশে এক যুগলকে অমানবিকভাবে কুঞ্চি দিয়ে প্রহার করছে সে। শোরগোল পড়ে যায় দেশজুড়ে। শাসকদলকে নিশানা করতে শুরু করে বিরোধীরা। এর পর ররিবার রাতেই গ্রেফতার হয় জেসিবি। সোমবার তার পাঁচ দিনের পুলিশি হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছে ইসলামপুর মহকুমা আদালত।
উত্তর দিনাজপুরের চোপড়ার লক্ষ্মীপুরে দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসছিল জেসিবির দাপট। ২০১৭ সাল থেকে তার উত্থান শুরু হয়। তার পর থেকেই জেসিবির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের উপর অত্যাচার, মারধর, খুন ও অপহরণের অভিযোগ ওঠে।
২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর রুস্তম আলি নামে চোপড়ার এক বাসিন্দা জেসিবির বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছিলেন থানায়। গোলাম মুস্তাফা ও আবুল নামে দু’জনের উপর অস্ত্র ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলার অভিযোগ তুলেছিলেন রুস্তম। সেই এফআইআরে মোট ৩৭ জনের নাম ছিল। এক নম্বরেই ছিল জেসিবির নাম। এর পর ২০১৯ সালে ১১ মার্চ আজিনা খাতুন নামে এক মহিলা চোপড়া থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। তাঁর অভিযোগ ছিল, ডাঙাপাড়া থেকে লক্ষ্মীপুর বাজারে যাওয়ার সময় তার উপর আক্রমণ চালিয়েছেন তাজিমুল ও তার দল। সেখানেও ৩১ জন অভিযুক্তের মধ্যে জেসিবির নাম রয়েছে। ২০২১ সালে জেসিবির বিরুদ্ধে অপহরণ করে খুনের অভিযোগ দায়ের হয়েছিল। ২ সেপ্টেম্বর তারিখে সাবুজান নেসা নামে এক মহিলা তাজিমুল ও তার দলবলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন চোপড়া থানায়। তার অভিযোগ ছিল, ১ সেপ্টেম্বর তার ছেলে ওসমান গনি ইসলামপুর কোর্ট থেকে বাড়ি ফিরছিলেন। সেই সময় তাকে অপহরণ করা হয়। দূরে কোথাও নিয়ে গিয়ে বেধড়ক মারধর করা হয় তাকে। গুলিও করা হয়। পরে তাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় চোপড়া হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয় শিলিগুড়ি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। মৃত্যু হয়েছিল ওসমান গনির। এর পর ২০২৩ সালে রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোটের মনোনয়নের শেষ দিনে বাম-কংগ্রেস জোটের মিছিলে গুলি চালানোর অভিযোগ উঠেছিল জেসিবির বিরুদ্ধে। সেই ঘটনায় এক সিপিএম নেতার মৃত্যুও হয়েছিল। পুলিশে যে অভিযোগ দায়ের হয়েছিল, তাতে জেসিবির নাম শুরুতেই ছিল বলে জানা যায়।
এত বার পুলিশের খাতায় নাম ওঠা সত্ত্বেও কখনওই জেসিবির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। অভিযোগ পেয়ে বেশ কয়েকবার জেসিবিকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল পুলিশ। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই তাকে ছেড়ে দেওয়া হত।
প্রশ্ন উঠেছে, স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক হামিদুল রহমানের ‘ঘনিষ্ঠ’ হওয়ার কারণেই কি বার বার তাকে মুক্তি দিত পুলিশ?
স্থানীয় এক সিপিএম নেতার কথায়, ‘বিধায়কের সঙ্গে থাকত জেসিবি। পুলিশ কিছু করতেই ভয় পেত।’’ চোপড়ার কংগ্রেস সভাপতি মাসিরুদ্দিন বলেন, ‘‘সন্ত্রাসের আবহ তৈরি করে রেখেছে জেসিবি। লক্ষ্মীপুর এলাকায় কেউ মাথা তুলে কথা বলতে পারছে না। ও গ্রেফতার হওয়ার পর মানুষ আস্তে আস্তে মুখ খুলছে। এর আগেও ওর অত্যাচারের ভিডিয়ো প্রকাশ্যে এসেছে।’
অবাঞ্ছিত ঘটার পরই তৎপর হয়ে ওঠে প্রশাসন। ঘুম ভাঙে রাজনীতিবিদদের। সোচ্চার হয় মানবাধিকার কর্মী। জেসিবির এই অমানবিক কর্মকাণ্ড আজ থেকে সংগঠিত হচ্ছে না। প্রকাশ্যে ক্ষমতাসীন রাজনীতি দলের প্রশয়ে তারা জঘণ্য কর্মকাণ্ড ঘটাচ্ছে। প্রশাসন চোখ বন্ধ করে আছে প্রভাবশালীদের দাপটের কারণে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, চোপড়া কাণ্ডের বর্বর নিষ্ঠুরতার দায় তৃণমূলকেই জনগণ কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে।