গতকাল সন্ধ্যায় কলেজস্ট্রিটের অন্যতম বিখ্যাত অভিযান পাবলিশারসের ছোট্ট ক্যাফেতে তখন তিল ধরানোর জায়গা ছিলনা। ঘড়িতে তখন ঠিক সন্ধ্যা ৬টা। অভিযান পাবলিশার্স আয়োজিত বাংলার প্রথম থ্রিলার লিট ফেস্ট এর চতুর্থ সন্ধ্যায় অভিযান পাবলিশার্স কর্ণধার মারুফ হোসেন আলোচনা সভায় আমন্ত্রণ জানালেন অতিথিদের। মূলমঞ্চে প্রকাশ্যে এলেন আনন্দ বাজার পত্রিকার সাংবাদিক ও লেখক দেবাঞ্জন মুখোপাধ্যায়, অনুষ্ঠান সঞ্চালিকা তানিয়া কুমার ও বিতর্কিত সমাজকর্মী রাজীব সরকার।
গতকাল ছিলো মঙ্গলবার, ২১শে মে। ইতিহাসের পাতায় এই দিনটিও একটি কালো দিন। ১৯৯১ সালের এই দিনেই দেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী রাজীব গান্ধী কে হত্যা করার গভীর ষড়যন্ত্র, মানব বোমার প্রচন্ড বিস্ফোরণ ও সাথে চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা শতাধিক মানুষের চ্ছিন্ন ভিন্ন দেহের পোড়া গন্ধ আর আর্তনাদ আজও অনুভব করা যায়। কিন্তু ইতিহাস বার বার পুনরাবৃত্তি হয়। হয়তো তাই কাকতালীয় ভাবেই আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রকাশ্যে এলেন বিতর্কিত সমাজকর্মী রাজীব সরকার। রাজীব সরকার নিজেও আশা করেননি যে তার কথা শুনতে ক্যাফে তে এতো মানুষ আসবেন। বাতানুকূল যন্ত্র ঘর শীতল রাখার ব্যার্থ প্রচেষ্টা তখনও প্রানপনে চালিয়ে যাচ্ছে।
লেখক ও সাংবাদিক দেবাঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের স্বল্প বক্তব্য শেষ হবার সাথে সাথেই সঞ্চালিকা তানিয়া কুমার বক্তব্য রাখতে অনুরোধ করেন সমাজকর্মী রাজীব সরকার কে। সেই রাজীব সরকার যিনি একসময় প্রশাসনের সাথে হাত মিলিয়ে ২০১২ থেকে ২০১৫ অবধি জীবন কে বাজি রেখে সমগ্র নিউ টাউন ও রাজারহাট অঞ্চলে গজিয়ে ওঠা অবৈধ ডান্স বার, নারী ও শিশু পাচার, নিষিদ্ধ মাদক, বেআইনি অস্ত্র চোরাচালান সহ অবৈধ নির্মানের মতো অপরাধের বিশাল নেটওয়ার্ক ভেঙে দিয়ে ছিলেন। নরওয়ে তে প্রবাসী দম্পতির থেকে কেড়ে নেওয়া দুই শিশু কে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসার মতো অজস্ৰ সাংঘাতিক কাজ করেছেন দেশ ও দশের মঙ্গলের জন্য। বারবার এসেছেন সংবাদ শিরোনামে।
অথচ এই রাজীব সরকার কেই ২০১৭ সালে কোন এক “অজানা কারণে” প্রশাসন নারী পাচার এর অপরাধ মামলায় জড়িয়ে গ্রেফতার করে। আবারও সংবাদ শিরোনামে এলেন রাজীব সরকার। দীর্ঘদিন সাংঘাতিক অপরাধী দের সাথে সংশোধনগরে ও পরবর্তী কালে নিজের শহর থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরে গৃহবন্দী ও দুররোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে বিনা চিকিৎসায় দিন কাটান। পরবর্তী কালে জামিন পেয়ে নিজের অসুস্থ বৃদ্ধ বাবা মার কাছে ফিরতে পারেন। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই কয়েক মাসের ব্যবধানে তার বাবা ও মা বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা ও মানসিক দুয়াচিন্তার চাপে মারা যান।
সেই থেকেই সমাজকর্মী রাজীব সরকার কোন অনুষ্ঠানেই অংশগ্রহণ করেন না। সমাজের মধ্যে থেকেও নিজেকে সমাজ থেকে একটু দূরে রেখে বার বার তার নিজের সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন তার জীবনের কঠিন বাস্তব, লিখেছেন কিভাবে প্রশাসনের কিছু মানুষ নিজ স্বার্থের কারণে ষড়যন্ত্র করেছেন।
এদিন অভিযান পাবলিশার্স এর আমন্ত্রণে প্রথমবার প্রকাশ্যে তার জীবনের শিহরণ জাগানো অভিজ্ঞতার সাথে সংশোধনগরে ভিতরের এমন অনেক তথ্য বলেন যা সাধারণ মানুষের কাছে অজানা। জেল জীবন ঠিক কেমন? কি হয় সেখানে? প্রায় কুড়ি বছর আগে কলকাতার হেতল পারেখ ধর্ষণ মামলার অপরাধী ধনঞ্জয় চ্যাটার্জি কে মামলায় জড়িয়ে ফাঁসির সময় ধনঞ্জয় চ্যাটার্জি কে যখন তার শেষ ইচ্ছার কথা জানতে চাওয়া হয় তখন ধনঞ্জয় চ্যাটার্জি ঠিক কি ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। আদৌ কি তার সেই ইচ্ছা পূরণ হয়েছিলো? বিনা অপরাধে শুধুমাত্র তৎকালীন একজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার স্ত্রীর শক্তির বলি ধনঞ্জয় চ্যাটার্জির ফাঁসির সময় জেলের বেশ কিছু আধিকারিক চোখের জল ফেলেছিলেন। ধনঞ্জয় কে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যাবার মুহূর্তে, কারাকর্মীদের কে অন্য সাজাপ্রাপ্ত আসামীরা কারাকর্মীদের “কাটোরা” ছুঁড়ে প্রতিবাদ করেছিলেন। কি এই “কাটোরা”? সব কিছুই অভিযান পাবলিশার্স এর পাঠক ও সাধারণ মানুষদের সামনে প্রকাশ্যে আনেন রাজীব সরকার। বুঝিয়ে দেন প্রকৃত স্পাই বা গুপ্তচর আর পুলিশের “খোছর” এর মধ্যে পার্থক্য ঠিক কতটা।
মাত্র আধ ঘন্টার এই আলোচনা সভায় সমাজকর্মী রাজীব সরকার তুলে ধরলেন বিগত কয়েক যুগের প্রশাসনের কাজের ধরণ, অপরাধ জগতের অজানা অন্ধকার রহস্য আর তার সাথে ঘটে যাওয়া অমানসিক অত্যাচার। অভিযান পাবলিশার্স এর ক্যাফে তখন উৎসাহী মানুষের ভিড়ে ঠাসা হলেও ছিলো এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। তখন শুধুমাত্র রেবেল রাজীব সরকারের কঠিন সত্যের অভিব্যক্তি। কিন্তু সময় কে ধরে রাখার ক্ষমতা তো কারোর নেই, রাজীব সরকারের মুখে বিগত যুগের অন্ধকার জগতের কথা শুনতে শুনতে যেন নিমেষেই কেটে গেল আধঘন্টা। আলোচনা সভা শেষ, এক অন্য অভিজ্ঞতা নিয়ে পাঠকরা হল ক্যাফে ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। সাক্ষী থেকে গেল কলেজ স্ট্রিটের অভিযান পাবলিশার্স এর ক্যাফের চার দেওয়াল। যারা আগামী প্রজন্ম কে নীরবতার সাথে শোনাবে রাজীব সরকারের কাহিনী।
গতকালের অনুষ্ঠানের ভিডিও রাখলাম আপনাদের জন্য…..