অম্বিকা কুন্ডু, কলকাতা
গোটা রাজ্য আর জি কর তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় উত্তাল। সাধারণ মানুষের সাথে টলিউডের প্রায় সকল অভিনেত্রীরা যোগদান করেছে। গত দিন সুপ্রিম কোর্টের শুনানির পর ছোট এবং বড় পর্দার অভিনেত্রী রূপাঞ্জনা মিত্র তার ফেসবুক পেজে অনুরাগ মিথ্যে একটু লেখাকে শেয়ার করেন যেখানে লেখা ছিল “মনে হচ্ছে ভীষণভাবে কিছু ভুল পারসেপশন তৈরি হচ্ছে।কয়েকটা বিষয় মাথায় রাখা অত্যন্ত দরকার নয়তো আমরা নিজেরাই এই আন্দোলন এবং সংশ্লিষ্ট মামলাটির অভিমুখ ঘুরিয়ে দেব। মাথা ঠান্ডা রেখে দাঁতে দাঁত চেপে এগোতে হবে। এখন ধৈর্য ধরে রাখাটাই তো সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ।
সুপ্রীমকোর্টে এই মুহূর্তে এই মামলার বিচার প্রক্রিয়া চলছে না, চলার কথা নয়। এই মামলার ট্রায়াল পার্ট তো শুরুই হয়নি, ইন ফ্যাক্ট তদন্তই শেষ হয়নি। তাহলে যারা আশা করছেন সুপ্রীম কোর্ট রায় দেবেন তারা ভুল ভাবছেন।
কোন মামলার ধাপ গুলো সম্পর্কে একটু ধারণা রাখা দরকার নতুবা আমাদের আন্দোলন গুলিয়ে যাবে।
এখন যেটি চলছে সেটি হল – “Court monitored investigation”। মহামান্য সর্বোচ্চ আদালত স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে এই তদন্ত মনিটর করছেন। মনিটরিং চলছে বলেই CBI কে “Status Report” জমা দিতে হচ্ছে। অর্থাৎ তদন্তের গতিপ্রকৃতি বা বলা ভালো অগ্রগতি মহামান্য আদালত দেখছেন। যে রিপোর্ট তদন্তকারী সংস্থা মুখবন্ধ খামে পেশ করছে সেটি হাইলি কনফিডেনশিয়াল এবং আমার আপনার জানার কথা নয়। আজ যারা লাইভ স্ট্রিমিং দেখেছেন, তারা নিশ্চই খেয়াল করেছেন যে মহামান্য বিচারপতিরা বলেছেন যে তদন্তে একটি নির্দিষ্ট অভিমুখ দেখা যাচ্ছে এবং আগামী সাতদিন পর সিবিআই নেক্সট রিপোর্ট জমা দিক।
এই ফেজে মহামান্য আদালত কি করবেন তাহলে? লক্ষ্য রাখবেন – তদন্তের গতির দিকে, তদন্তের আওতায় কি কি থাকছে বা থাকতে পারে সেদিকেও নজর রাখবেন। আশা করা যায় নির্দিষ্ট একটা সময়ে তদন্ত যাতে সুসম্পন্ন হয় সেদিকেও সর্বোচ্চ আদালত নজর রাখবেন।
এই ফেজে মহামান্য আদালত কিছু অবজারভেশন ওরিয়েন্টেড অর্ডার দিতে পারেন বা দেবেন। রায়, বিচার এইসব বিষয়গুলি এখন আসেইনা।
আমরা কি চাইছি? বিচার চাইছি। অর্থাৎ প্রকৃত অপরাধী শাস্তি পাক, তার মানে conviction হোক। সিবিআই কে সেক্ষেত্রে একটি “Water tight” চার্জশিট দিতে হবে “কোর্টগ্রাহ্য এভিডেন্স” সমেত।
এবার ঘটনাটির কথা আরেকবার ভাবুন ভাল করে। Heinous crime – complex in nature; এর তদন্ত খুব সহজ নয়। সময় একটু লাগবেই।
তাহলে আগামী ধাপগুলো কি কি? তদন্ত শেষ হবে – চার্জশিট ফাইল হবে – চার্জশিটে কে বা কারা অভিযুক্ত সেটা স্পষ্ট হবে – আদালত চার্জশিট গ্রহণ করবেন – চার্জ ফ্রেম হবে – ট্রায়াল শুরু হবে। এই ট্রায়ালের নির্দিষ্ট কিছু ফেজ থাকবে। ফাইনালি এভিডেন্স এবং আর্গুমেন্ট শেষ হলে আসবে সেই বহু প্রতীক্ষিত সময় – “Verdict”। মামলার রায় বেরোবে।
এবার প্রশ্ন এই যে ট্রায়াল পার্ট অর্থাৎ বিচার, এটা কোথায় হবে? যতদূর জানি এটা তো কোন ফাস্ট ট্র্যাক লোয়ার কোর্টেই হওয়ার কথা।
সুতরাং ফেসবুকে যারা লিখে যাচ্ছেন – “তারিখ পে তারিখ”, “সেটিং” ইত্যাদি ইত্যাদি তারা কিন্তু একদিক থেকে মামলাটির ক্ষতি করছেন। আইন, বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে fundamental factors না জেনে আন্দোলন করলে কিন্তু আখেরে আন্দোলনেরই ক্ষতি হবে।
তাহলে এখন কি হবে? ধৈর্য ধরতেই হবে, আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। দেখতে হবে তদন্ত কিভাবে ও কবে শেষ হয়। মনে রাখতে হবে “tampering of evidences” প্রমাণ করতে পারাটাও কিন্তু একটা গুরুত্বপূর্ণ এভিডেন্স।
Justice hurried is justice buried এবং Justice delayed is justice denied – এই দুটোই কিন্তু চূড়ান্ত সত্যি। এখানেই কনফিউশন – তাড়াহুড়ো হচ্ছে নাকি দীর্ঘসূত্রিতা, সেটা আমরা বুঝবো কি করে? সেটা বুঝতে হবে volume and nature of the case অনুধাবন করে। কি জাতীয় অপরাধ হয়েছে, hostility কতটা, তদন্ত টাইমফ্রেম অনুসারে চার্জশিট কিরকম হল, সাক্ষ্যগ্রহন পর্ব কতটা – এই সবকিছুর ওপর নির্ভর করবে চূড়ান্ত পরিণতি। আমাদের মাথা ঠান্ডা রেখে, নিজেদের বোধ বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে বিচার করতে হবে যে ঠিক কতটা ধৈর্য আমাদের ধরা উচিত।
‘তিলোত্তমা’ চলে গিয়ে প্রমাণ করেছে যে সে যায়নি। অধৈর্য হয়ে, বিভ্রান্ত হয়ে, বেসিক কিছু জিনিস না বুঝে ফেসবুক বিপ্লবের ফাঁদে পা দিলে তিলোত্তমা বিচার পাবে না। এই গনজাগরনকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে সংবিধান মেনে গণতান্ত্রিক উপায়ে।
গত কয়েকদিন ধরে ফেসবুকে প্রচুর পোস্ট দেখেছি। আমার অনেক পরিচিতজনেরাও করছেন। তাতে সর্বোচ্চ আদালত, প্রধান বিচারপতিকেও আক্রমণ করা হচ্ছে। এগুলো থেকে বিরত থাকুন। নাহলে আপনার অজান্তেই বিপদ হতে পারে। প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, আন্দোলন যাই করা হবে, সেটা সংবিধানকে মর্যাদা দিয়েই করতে হবে।সোশ্যাল মিডিয়া কিন্তু বড় ভয়ানক জায়গা।
পরিশেষে বলি – পৃথিবীর ইতিহাস হলো মানুষের জাস্টিস চাওয়ার এবং পাওয়ার লড়াইয়ের ইতিহাস। সেই ইতিহাস কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব আমাদের।”