বহতা নদী সরকার :
পাড়ার সবাই তাকে নবারুণদা বলে ডাকেন। বয়স পঁত্রিশ কি চল্লিশ হবে । হাসি-খুশি মানুষ। সুঠাম দেহ। শক্তিশালী। কাজে কোনো আলসেমি নেই। ঝড়-বৃষ্টি, দিন কি রাতে মানুষ ডাকলেই তাকে পায়। এই নবারুণদাকে পাড়ার সবাই ভেবেচিন্তে কাউন্সিলর পদে দাঁড় করিয়ে দিলেন। ভোটে বিজয়ীও হলেন। শুরু হলো নবারুণদার নতুন জীবন। কয়েকদিন যেতে না যেতে তিনি একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হলেন। আরো কিছুদিন যেতে না যেতে তিনি বাইক ফেলে চার চাকার গাড়ি কিনে ফেললেন। আগে নবারুণদার সঙ্গে কথা বলা যেত, ইয়ার্কি-ফাজলামি করা যেত, মোড়ের দোকানে চা খাওয়া যেত। এখন আর সেটা হয় না। গাড়ির কাচই খোলেন না। কালো চশমা পরেন। অন্য পাড়ায় থাকেন। তার দেখা পওয়াও কষ্টকর হয়ে গেল। গরিব মানুষ দিনের পর দিন তার কাছে কাজে গিয়ে ফিরে আসতে লাগলেন। পাঁচ বছর ঘুরতে না ঘুরতে তিন তিনটা বাড়ির মালিক হয়ে গেলেন।
তার পরের গল্প বাংলার গঙ্গা জলের মতো পরিষ্কার। পার্টির নমিনেশন পেয়ে এখন তিনি বিধায়ক। থাকেন শহরেরই। উঁচু মহলেই ওঠা-বসা। এখন পাড়ার কথা ভুলে গেছেন। কিন্তু পাড়ার মানুষ নবারুণদাকে ভোলেনি। ভুলবে কেমন করে। প্রায়ই তার দুর্নীতির খবর বড় বড় অক্ষরে খবরের কাগজে ছাপা হয়। সবকিছু সামলেও নেন তিনি। পারেনও বটে। দুই দশকের ওপরে রাজনীতির বয়স। রাজনীতির অলিগলি তো তিনি চিনেই গেছেন। এখন তার জীবনের দাম অনেক। দেহরক্ষী নিয়ে চলাফেরা করেন।
এটা একজন নবারুণদা গল্প। এমন অনেক নবারুণদা আছে আমাদের বাংলার ক্ষমতায়। তারা ক্ষমতার জোরে যা নয় তাই করছে। মিথ্যেকে সত্যি প্রমাণ করছে। সত্যিকে মিথ্যে প্রমাণ করছে। স্বজনপ্রীতি করে রাজ্য চালাচ্ছে। ঘুষ নিয়ে চাকরি দিচ্ছে। তা না হলে কেমন করে ২০২০ সালে করোনাকালে দক্ষিণ দমদম পুরসভায় নিয়োগে একই দিনে ২৯ জন পুরসভায় যোগদান করেন? যেদিন ওই নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছিল সেদিনই নিয়োগপত্র পান ২৯ জন। একই দিনে চাকরিতে যোগদানও করেন সবাই। কেন একজন মন্ত্রী রেশনের বড়সড় দুর্নীতি নিয়ে গ্রেফতার হন?এমন উদাহরণ রাজ্যে একটা নয়, একাধিক আছে। প্রশ্ন জাগে কেন সারদা, নারদা এবং রোজভ্যালি কাণ্ডে তদন্তকারী সিবিআই পুলিশ কি বদলি করা হয়েছে গোপনে? এমন অনেক প্রশ্ন আছে যার উত্তর সাধারণ মানুষের জানা নেই। তারা কোনোদিন জানতে পারবেও না।
দেশে আলোচিত হয় শেখ শাহজাহান কাণ্ড। ২০০৬ সাল থেকে এলাকা প্রভাব বিস্তার করেছিল সন্দেশখালি কাণ্ডে ধৃত শেখ শাহজাহান। বাম জমানায় এলাকার প্রতাপশালী ‘গুন্ডা’ হয়ে উঠেছিল সে। এরপর ২০১৩ সালে রাজনীতিতে যোগ দেয় শাহজাহান। তৃণমূলের নানান পদ পায়। এহেন শাহজাহান আড়ালে থেকে টেন্ডার দুর্নীতি চালাত বলে জানা যায়।
নবারুণ, শাহজাহান, জেসিবির মতো মানুষে ভরে গেছে দেশ। এখন দেশের প্রধান ব্যবসা হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনীতি। তাই তারকারা রাজনীতিতে আসছে, খেলোয়ারেরা রাজনীতিতে আসছে, ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে আসছে। তারা ভোট পেতে যেভাবে দুহাতে টাকা ছড়াচ্ছে তেমনি নানা দুর্নীতির মধ্যে দিয়ে তা কয়েকগুণ বেশি উসুল করে নিচ্ছে। এদের দেশের প্রতি ভালোবাসা নেই। এরা নিজেকে ভালোবেসে তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সম্পদের পাহাড় গড়ে রাখতে চায়। ভবিতব্যই জানে এই দুর্নীতির শেষ কোথায় ?
মুখে এক আর বুকে আরেক কথার মানুষরাই এখন জনগণের ভাগ্য বিধাতা। আমরা তাদেরকে নেতা হিসেবে গড়ে তুলেছি। তারা এখন আমাদের শোষণ করছে। ক্ষমতার হিংস্রতা সাংঘাতিক! ক্ষমতার বদৌলতে তারা আমাদের অধিকার বঞ্চিত করছে। আমাদের সম্পদ লুট করছে। আমাদের আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ লুট করছে। আমরা মুখ বুজে আছি। মুখ বুজে আবার তাকেই ভোট দিয়ে প্রতিনিধি নির্বাচিত করছি। দেশে চলমান এই দুর্নীতির জন্য আমরাও কি কম দায়ী?