সম্প্রতি প্রকাশিত হল শ্রী সনাতন বাউল দাস ঠাকুর লিখিত “বাউল প্রেমিক” গ্রন্থের চতুর্থ সংস্করণ। এদিন আই সি সি আর এর সত্যজিত রায় অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠানে পার্বতী বাউল ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়, প্রচেত গুপ্ত, দামোদর গোসাই, বিশ্বনাথ দাস বাউল, মদন গোসাই ও আই সি সি আর প্রধান মীনাক্ষী মিশ্র।
“বাউল প্রেমিক” গ্রন্থটি সম্পর্কে জানতে চাইলে পার্বতী
বাউল আমাদের জানান –
বাউল প্রেমিক বইটি শ্রী সনাতন বাউল দাস ঠাকুরের সম্পূর্ণ সাধনজীবনের ফসল। আমি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে চাই যে, এই বইটিই প্রথম— যা আধুনিক শিক্ষিত সমাজের সঙ্গে বাউল সাধনাকে পরিচিত করাতে চেয়েছে, যা একজন বাউলসাধকের নিজের লেখা। ‘বাউল প্রেমিক’ গ্রন্থটি একজন বাউল ও প্রেমিকের মধ্যে কথোপকথন। প্রেমিক প্রশ্ন করেন আর বাউল তাঁর মহাজনী জ্ঞানভাণ্ডারের উপরে ভিত্তি করে পদগুলিকে ব্যাখ্যা করে প্রেমিকের প্রশ্নের সমাধান করেন। এই কথোপকথন চলতে চলতে শেষের দিকে বাউল গভীর সাধনতত্ত্বে প্রবেশ করেন।
সেই কারণেই এই বইটি অন্য কোনো বর্ণনামূলক বইয়ের চেয়ে আলাদা। বহু প্রাচীন ও মূল্যবান শাস্ত্র-পুঁথিতেও এমন কথোপকথনের মাধ্যমে বহু গভীর সাধন-রহস্যের ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যেমন— কঠোপনিষদে নচিকেতা-ধর্মরাজের কথোপকথন বা শিব স্বরোদয়াতে শিব-পার্বতীর কথোপকথন। কোথাও যেন বইটি আবার একটি নাটকের ভাবও তৈরি করে। ‘বাউল প্রেমিক’ গ্রন্থটি বাউল সাধকদের একনিষ্ঠ জীবনের সাথে আমাদের পরিচয় ঘটায়। গ্রন্থটি পাঠ করে আমাদের বাউল মার্গ (যোগ ও ভক্তি) সম্বন্ধে অনেক ধারণা পরিষ্কার হয়। বাউল সঙ্গীত ও সাধনা পরস্পরের পরিপূরক— একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটি নয়। যত দিন বাউল সাধনা ও সঙ্গীত সম্পৃক্ত থাকবে, তত দিন বাউলের ভাব বজায় থাকবে। সাধনাবিহীন শুধু সঙ্গীত হয় না।
বাউল মার্গে পুরো শিক্ষাটাই শ্রুতিনির্ভর। সেই ধারা অনুসরণ করে গুরু শ্রী সনাতন দাস বাউল এই গ্রন্থে লিখিত রূপে প্রকাশ করেছেন। সেই জন্য এই গ্রন্থটি বাউল সমাজের একটি মূল্যবান আকরগ্রন্থ ও সম্পদ হয়ে থাকবে। এবং আগামীতে যাঁরা বাউল চর্চা ও সাধনা করবেন, অথবা যাঁরা আগ্রহী হবেন, তাঁদের এই গ্রন্থ অবশ্যই পঠনীয়।
পূর্ব প্রকাশিত বাউল প্রেমিক গ্রন্থটিকে এই চতুর্থ সংস্করণে ‘সূত্রপাত’ অংশে রাখা হয়েছে এবং অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি ‘অন্তিম চরণ’ অংশে রাখা হয়েছে। তৃতীয় সংস্করণে বাউল ও প্রেমিকের মধ্যে যে বার্তালাপের সূত্র খণ্ডিত ছিল এই সংস্করণে তাদের কথোপকথন একই সূত্রে একটি নদীর প্রবাহের মতো নিরন্তন ভাবে বাহিত হলো। জাপানের অধ্যাপক শ্রী মাসাইউকি ওনিশি ও কলকাতা নিবাসী অধ্যাপক শ্রী দুর্গা দত্ত তাঁদের নেওয়া সাক্ষাৎকারটি নির্দ্বিধায় প্রকাশ করতে দেওয়ায়, যাঁরা বাবাকে দেখেননি তাঁরা কথা/শব্দের মাধ্যমে বাবাকে স্পর্শ করতে পারবেন বলে আশা রাখি। এ ছাড়াও এই গ্রন্থে সংযোজিত হল বাবার স্বরচিত সঙ্গীত ও বেশ কিছু ছবি। বাবার গাওয়া কিছু অডিও ট্র্যাকও এই বইতে সংযোজন করা হল।
আত্মতত্ত্বে সমৃদ্ধ এই বই আপনাদের অন্তরকে বিকশিত করুক। বিশ্বে বিরাজমান অনুরাগী পাঠকদের উপর মহাত্মা-সাধক-গুরু শ্রীশ্রী সনাতনদাস বাউলের আশীর্বাদ ও কৃপা বর্ষিত হোক— এই প্রার্থনা ও সংকল্প নিয়ে আমি এই দিব্য পুস্তকখানি আমার গুরুর চরণে অর্পণ করলাম।
সনাতন সিদ্ধাশ্রম
সনাতন সিদ্ধাশ্রম হল একতারা কালারি ট্রাস্টের একটি ফ্ল্যাগশিপ প্রকল্প, একটি অলাভজনক দাতব্য সংস্থা যা প্রাচীন ভারতীয় জ্ঞান পরম্পরার সাধক- ধারক – বাহকদের সমর্থন করে।
পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলায় ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত সনাতন সিদ্ধাশ্রম, বিশেষ করে বাংলার বাউল ঐতিহ্যের ও পরম্পরার প্রতি নিবেদিত। এর লক্ষ্য বাউল দর্শন প্রচার করা এবং এর নিবেদিতপ্রাণ সাধকদের বিভিন্ন ভাবে সহায়তা করা।
এটি মহান বাউল গুরু শ্রী সনাতন দাস বাউলের নামে নামকরণ করা হয়েছে, যিনি এই প্রাচীন যৌগিক আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যে সাধনায় অতুলনীয় অবদান রেখেছেন। তিনি সনাতন সিদ্ধাশ্রমকে একটি শিক্ষা কেন্দ্র হিসাবে কল্পনা করেছিলেন যা বাউল পরম্পরার অনুগামীদের পরবর্তী প্রজন্মের বিকাশ ঘটাবে। এই বিশেষ বাউল জ্ঞান ছড়ানো ও শিক্ষার প্রসারের জন্য তিনি শ্রীমতি পার্বতী বাউলকে মনোনীত নিয়েছিলেন।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে সনাতন সিদ্ধাশ্রম বাউল ঐতিহ্যের আধ্যাত্মিক বার্তা গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং এই প্রক্রিয়ায় অনেক বাউল পরিবার এবং বেশ কয়েকজন প্রবীণ বাউল গুরুদের ও কিছু বাউল আশ্রমের সহায়তা করে এসেছে বহু বছর ধরে। এটি স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং পুষ্টির ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি পরিষেবা উদ্যোগও শুরু করেছে। প্রতিবেশী গ্রামবাসীরা এই পর্যায়ক্রমিক কর্মসূচী থেকে ব্যাপকভাবে উপকৃত হয়েছে।