অমিশি রায় ঃ আসতে চলেছে সাতের দশক, কলকাতায় তখন মাঝে মাঝে দু একটা খুন। কোথাও রক্ত কোথাও বোমা আবার কোথাও পুলিশি টহিলদারী। অবশ্য সেদিন সীতারাম ঘোষ স্ট্রীট এর কাছাকাছি কোনো পুলিশ টহিল ছিল না । আর তারই সুযোগ নিয়ে সেখানে একজনের অপেক্ষায় ওত পেতে ছিল রহস্যময় দুইজন । মাঝে মাঝে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তারা সময় দেখছে আর যে হাতে ঘড়ি দেখছে সেই হাতেই শুধু ভাবে লুকানো বহু খুনে অভ্যস্ত ছুরি। দুজনের একজনের নাম নকুল সে অবশ্য এ পারারই ছেলে অন্য জন বরানগরের নীলু।
কেষ্টা, তার জন্যই তাদের এত অপেক্ষা তার জন্য তাদের ঘড়ির কাঁটা ধারালো হয়ে উঠছে একটু পরেই যেন চার দিকটা রক্তে ভেসে যাবে। কিন্তু সেরকম সুবিধে করে উঠতে পারল না এই দুই জাঁদরেল। কারণ ‘কেষ্টা’কো পকড়না মুশকিল হি নেহি, না মুমকিন হ্যায়। ছুরির কোপ লেগেছিল বটে, তবে যুযুধান দুই প্রতিপক্ষের লড়াইয়ে জিতে গিয়েছিলেন একলা কেষ্টা নামক যুবকটি। ছুরির কোপের আঘাতে ভরতি হতে হয়েছিল মেডিক্যাল কলেজেও, তবে যখন ফের পা রাখছেন পাড়ায়, কিন্তু ততক্ষণে নাম হয়ে গিয়েছে ‘ফাটাকেষ্ট’।
কয়েকটা ছুরির কোপ শুধু তাকেই নয়, আঘাত করেছিল তার নামকেও। সেই থেকেই তিনি ‘ফাটাকেষ্ট’। আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে । তারপর একের পর এক নিলামের কারবার সামলানো, নকশাল-দমন, মুকুটে পর পর সাফল্যের পালক তিনি ।
নকশাল আমলে ওই তল্লাটেই মির্জাপুর স্ট্রিটের ছেলে জনৈক ‘গন্ডার’ ফাটাকেষ্টকে বোমা মেরেছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় সেই বোমা ফাটেনি, ফাটা কেষ্ট সেই বোমা হাতে তুলে নিয়ে পাল্টা ছুড়ে মারেন ।
নরেন সেন স্কোয়্যারের মাঠের কাছে ওই জায়গাতেই ফাটাকেষ্টর ক্লাব যার নাম নবযুবক সংঘের ঘর। উত্তম-সুচিত্রা থেকে শুরু করে লেভ ইয়াসিন, অমিতাভ, রাজেশ খন্না, বিনোদ খন্না, জিতেন্দ্র, মালা সিন্হা, আর ডি-আশা ,কে না এসেছেন সেখানে।
মণ্ডপের অনেক পিছনে হ্যারিসন রোডের গলিটা ধরে কোন ফিল্মস্টার বা নেতা ঢুকলেন, সেই সব কিছুই শেষ মুহূর্ত অবধি গোপন থাকত। ক্লাবঘর থেকে ল্যান্ডফোনে খবর যেত কেশব সেন স্ট্রিটের অফিসে। তার পরই জনতাকে চমকে মাইকে ঘোষণা হত ! নাটক টা এতটাই ভাল বুঝতেন ফাটাকেষ্ট যে বলার মত না । কাশী থেকে সীতারামদাস ওঙ্কারনাথ ঠাকুর আসার সময়ে তাঁকে কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন তিনি । জটাজুটধারী সাধুকে ঘাড়ে নিয়ে জনসমুদ্র ঠেলে ঢুকছেন ফাটাকেষ্ট, দেখে পাবলিক পাগল হয়ে গিয়েছিল!
কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হল , কে এই ফাটাকেষ্ট? কী তার আসল পরিচয় ? আদেও মানুষ তো ??
হ্যাঁ হ্যাঁ মানুষ বটে…. তার আসল নাম ‘কৃষ্ণচন্দ্র দত্ত’। কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে তার বাবার পানের দোকান রয়েছে। ফাটাকেষটো নিজেও সে পানের দোকান দেখাশোনা করত। তিনি ছিলেন বিশাল কালি ভক্ত।
কালীভক্ত এই মানুষটি ঠনঠনিয়া কালীবাড়ির কাছে মাঝেমধ্যেই দাঁড়িয়ে ভাবতেন জমিয়ে পুজো করার কথা।
ভাবনা কি সত্যি করে ১৯৫৫ সালে প্রথমবারের জন্য শুরু করেন কালীপুজো। তবে তখন সেই পুজো অবশ্য আজকের মতো বিরাট করে হত না। শুরুতে এই পুজোর ঠিকানা ছিল গুরুপ্রসাদ চৌধুরি লেনে। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মনোমালিন্য হাওয়ার পর পুজো তুলে আনেন সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটের একটি ঘরে। বছর দুই পরে পারমিশন নিয়ে যা নেমে এল রাস্তায়।
শরীরচর্চার রেওয়াজ ছিল ফাটাকেষ্টর। ডাম্বেলও ভাঁজতেন মাঝেসাঝে। পেটাই চেহারা,গালে রয়েছে বসন্তদাগ।
উত্তমকুমার এর কথা , হ্যাঁ, স্বয়ং উত্তমকুমারও মৃত্যুর আগের বছর পর্যন্ত একটানা এসেছেন এই ফাটাকেষ্টর পুজোয়। যখন নেমন্তন্ন করতে যাওয়া হত, বলতেন, ‘শুটিং না পড়লে পুজোর সময়ে যাব, নইলে আগেভাগেই যাব।’ প্রণাম সেরে প্রতিবারই মঞ্চে কিছু না কিছু বলে যেতেন উত্তমকুমার।
তবে অন্যদিকে পুজোর জাঁকজমকে সোমেন মিত্তিরের পুজোও কম যেত না! কিন্তু বাস্তব-অতিবাস্তবের মিশেলে কেষ্টা দার আলাদা মেজাজ। তাঁর পুজোয় কালীর ভরের কথা শুনলে সোমেন বলেন, ও সবে একটু ইয়ে আছে! ফাটা কেষ্টর আবার দু’টো টেক্কা— ভাসানের জাঁকজমক আর উত্তমকুমার! কিন্তু বছর-বছর কেন মহানায়ক শুধু ফাটাকেষ্টর পুজোতেই যেতেন? সত্যিই অদ্ভুত … কেউ কেউ বলেন, উত্তমের এই ফাটা-প্রীতির মধ্যেও আদতে ভয়! যেটা কি না নকশাল-আমল পরবর্তী আতঙ্ক। আসলে মাথার উপরে ডাকাবুকো ফাটার বরাভয় সম্ভবত মহানায়কও জরুরি মনে করতেন। এ নিয়ে জটিলতাও কম হয়নি। শোনা যায়, ফাটার প্রতিপক্ষ-শিবির এক বার কৈফিয়ত চায় উত্তমের কাছে , আমাদের পুজোয় যাবেন না তো ফাটাকেষ্টর পুজোয় কেন যান? উত্তম বলেছিলেন, ‘‘ও তো আমার নিজের পুজো!’’ এই ঘটনার পরেই বিবেকানন্দ রোডে উত্তম-পুত্র গৌতমের ওষুধের দোকানের কাছে মস্ত বোমা পড়ে। এক মহিলা মারা গিয়েছিলেন। উত্তমকুমারের সঙ্গে ফাটাকেষ্টর সম্পর্ক কিন্তু আমৃত্যু টাল খায়নি। উত্তমের মৃত্যুর পর ফাটার মঞ্চে তারকাখচিত স্মরণসভা হয়।
ফাটাকেষ্টর বিয়ের গল্পেও উত্তমকুমার অনিবার্য । পাড়ার একটি মেয়েকে পালিয়ে বিয়ে করেছিলেন কেষ্ট। মজার ঘটনা হল চালু মিথ, শ্বশুরমশাই বাগড়া দিতে পারেন ভেবে জামাই বাবাজীবন তাঁকেও তুলে নেন। তবে ফাটাকেষ্টর এক বন্ধুর থিয়েটার রোডের ডেরায় নাকি বিয়ে হয়েছিল। খাবার এসেছিল চাংওয়া থেকে। পরে বড় করে অনুষ্ঠান হয়। উত্তমকুমার এসে সোনার দুল দিয়ে বউমাকে আশীর্বাদ করেছিলেন।
তখন ১৯৭৩ সাল। হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের ‘নমকহারাম’ ছবিটি তখন সিনেমা হলগুলোয় চলছে রমরমিয়ে। রাজেশ খান্না-অমিতাভ-রেখা হল সুপারহিট। অমিতাভ-রাজেশ খান্না , দর্শক কার ফ্যান রূপে পরিচয় দেবেন তা ভাবতে ভাবতেই কুপোকাৎ!
উপরের তথ্যটি প্রায় সকলেরই জানা। কিন্তু ‘নমকহারাম’-এর ডায়লগ অমিতাভ কেবলমাত্র সিনেমাতেই দেননি, দিয়েছিলেন এই কলকাতার খাস একটি কালীপুজোর মঞ্চে।মানুষের স্মৃতি তখনও টাটকা, ‘নমকহারাম’ সিনেমার বছর এক পরের ঘটনা রাত তখন প্রায় সাড়ে দশটার কাছাকাছি। এক হাত পকেটে দিয়ে, মাথাটা সামান্য ঝুঁকিয়ে বাঁদিক থেকে ডানদিকে, ভ্রুকুঞ্চন সহযোগে ও বচ্চনভঙ্গিমায়, সেই আদি, জলদগম্ভীর গলায় বলে ওঠেন : কওন হ্যায় ওহ্ মাইকালাল…’
তখনও বচ্চন ‘বিগ-বি’ হয়ে ওঠেননি। কলকাতায় এসেছিলেন ‘দো আনজানে’ ছবির শুটিংয়ে। পরিচালক দুলাল গুহ। অভিনয়ে অমিতাভ-রেখা-প্রেম চোপড়া। দুলাল গুহর কলেজ স্ট্রিটের একটি পুজো কর্মকর্তাদের কাছে উপস্থিত হয়ে বললেন, ‘গ্র্যান্ড হোটেলে এসে দেখা করো অমিতাভের সঙ্গে। তোমাদের পুজোতে আসতে বলো ওঁকে।
ব্যাস কথামতো কাজ। গ্র্যান্ড হোটেলে উপস্থিত ফাটাকেষ্ট! দোসর রয়েছে সুকৃতি দত্ত। দুলাল গুহ ফাটাকেষ্টর পরিচয় দিতেই অমিতাভ জড়িয়ে ধরলেন তাঁকে। কালো রঙের হাতকাটা গেঞ্জি ওই পরা অমিতাভকে পুজোয় আসার কথা বলতেই তিনি একপায়ে খাড়া। তারপর রাত সাড়ে ন’টায় আনতে যাওয়া হল তাঁকে।
১২টা থেকে ‘দো আনজানে’-র শুটিং আগে থেকেই স্থির, তবু এলেন। এসে চারিদিক কিছুটা ঘুরে দেখে ডায়লগ দিয়ে জয়ো করলেন সবটা। তবে কালী মূর্তির সামনে দাঁড়িয়েছিলেন ঠায় বেশ কিছুক্ষণ। পরবর্তীকালে হিরে বসানো সোনার একটি নাকছাবিও পাঠিয়েছিলেন অমিতাভ। যদিও পরে চুরি হয়ে সেটি। কিন্তু আবার চোর ধরাও পড়ে। যে দোকানে বেচে দিয়েছিল, তা আবার গলানোও হয়ে গিয়েছে। ফলে নতুন করে গড়া হল আবার।
’৮২ সালের কলকাতা। কলেজ স্ট্রিটে, বাটার মোড় থেকে একটা রহস্যজনক গাড়ি বাঁক নিল আমহার্স্ট স্ট্রিটের দিকে। রহস্যজনক এই কারণেই যে পুজোমণ্ডপ থেকে কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো মাইকে ঘোষণা হয়েছিল: আমাদের মধ্যে এসে পড়েছেন মুম্বইয়ের বিখ্যাত গায়িকা আশা ভোঁশলে। চারিদিকে ধ্বনি-প্রতিধ্বনি। ঘোষণামাত্র পুরো পাড়া তোলপাড়! বেপাড়া থেকেও লোকজন ছুটে এসেছে। পাড়ায় এ-ওকে হাঁক পেড়ে পেড়ে ডেকে আনছে। পুলিশ ততক্ষণে মোতায়েন হয়ে গিয়েছে। প্রথম দিনে আশাপূরণ হয়নি। দ্বিতীয় দিনে আশা সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন ‘পঞ্চম’কে-আর. ডি বর্মন! ভারতীয় সংগীত ইতিহাসের দুই কিংবদন্তি কিনা পাড়ার মণ্ডপে বাঁধা একটি মাচায় গান গেয়েছিলেন। সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটের রাস্তাটা তখন লোকে লোকারণ্য। সকলে বিস্ময়াভিভূত! সবাই বলছিল সবই মায়ের কৃপা। কালীর টানেই তো এসে পড়া এতদূরে। সঙ্গে অবশ্যই রয়েছেন ফাটাকেষ্ট! তাঁরই উদ্যোগেই তো এই পুজো।