কার্তিক পূজা হিন্দুদের একটি পুজো। কার্তিক হল হিন্দু যুদ্ধদেবতা। দেবাদিদেব মহাদেব শিব ও দশভুজা দুর্গার আদরের ছোট পুত্র কার্তিক। গণেশ তাঁর দাদা। তবে কোনও কোনও পুরাণে কার্তিককে বড় এবং গণেশকে ছোট পুত্র বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এসব নিয়ে নানা মতপার্থক্যও আছে। কার্তিক বৈদিক দেবতা নন; তিনি পৌরাণিক দেবতা। প্রাচীন ভারতে সর্বত্র কার্তিক পূজা প্রচলিত ছিল। উত্তর ভারতে ইনি এক প্রাচীন দেবতা রূপে পরিচিত । অন্যান্য হিন্দু দেবদেবীর মতো কার্তিকও একাধিক নামে অভিহিত হন। যেমন – কৃত্তিকাসুত, আম্বিকেয়, নমুচি, স্কন্দ, শিখিধ্বজ, অগ্নিজ, বাহুলেয়, ক্রৌঞ্চারতি, শরজ, তারকারি, শক্তিপাণি, বিশাখ, ষড়ানন, গুহ, ষান্মাতুর, কুমার, সৌরসেন, দেবসেনাপতি ইত্যাদি।
কার্তিক হিন্দুদের উর্বরতার দেবতা। কার্তিক পূজার মাধ্যমে দম্পতিরা সন্তান প্রার্থনা করে থাকেন৷ কথিত আছে দেবকী কার্তিকের ব্রত করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কে পুত্ররূপে লাভ করেছিলেন ৷ কথায় বলে কার্তিকের মতো চেহারা অর্থাৎ কার্তিকের দেহ আকৃতি অত্যন্ত সুন্দর ও বলিষ্ঠ এই কারণে কার্তিক পূজার মাধ্যমে দম্পতিরা সুন্দর ও বলিষ্ঠ চেহারার সন্তান প্রার্থনা করে থাকেন ৷ কার্তিকের পূজা খালি সন্তানপ্রাপ্তির পূজা নয়,এ পুরানকথার সাপেক্ষে তৈরী স্থানীয় লোকাচার মাত্র।কথিত আছে কার্তিক ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর পুত্রীদের বিবাহ করেন। ব্রহ্মা ও সাবিত্রীর মেয়ে দেবী ষষ্ঠী পুরাণমতে কার্তিকের স্ত্রী,যিনি জন্ম ও জন্মসুত্রের দেবী। সেই কারণেই হয়তো বঙ্গদেশে সন্তানলাভের আশায় কার্তিক পূজা করা হয়। কার্তিক দেবতাদের সেনাপতি তিনি অসীম শক্তিধর দেবতা এজন্য তাকে রক্ষা কর্তা হিসেবে পূজা করা হয়৷ কার্তিক নম্র ও বিনয়ী স্বভাবের দেবতা৷ কিন্তু সমাজের নেই অন্যায় ও অবিচার নির্মূলে তিনি অবিচল যোদ্ধা৷ আমরা কার্তিকের ন্যায় প্রতিষ্ঠার আদর্শ অনুসরণে নীতিবান হতে পারি৷ তাকে অনুসরণ করে বিনয়ী মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারি এবং আদর্শ সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারি ৷আমাদের সকলকেই কার্তিকের মতন নম্র ও বিনয়ী হওয়া উচিত এবং অন্যায় অত্যাচার ও অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া উচিত ৷
পূরানে শিব ও পার্বতীর পুত্র কার্তিক বা কুমার কার্তিকেয় হলেন যুদ্ধের দেবতা, ময়ূর তার বাহন। তিনি চিরকুমার অর্থাৎ অবিবাহিত। আবার কোথাও বলা হয়েছে যে কার্তিকের পত্নী হলেন ষষ্ঠী দেবী। কালিদাসের ‘কুমারসম্ভব’ কাব্য পড়লে জানা যাবে কার্তিকের জন্মের আসল পৌরাণিক কারণ। তারকাসুরকে বধ করার উদ্দেশ্যে তার জন্ম হয়।
দৈবী বরে তিনি কেবল শিব এবং দুর্গার পুত্রের দ্বারাই বধ হবেন। ফলে নিজেকে অজেয় মনে করে দেবলোকে প্রবল সন্ত্রাস সৃষ্টি করতে শুরু করেন তারকাসুর। দেবতারা মিলিত হয়ে মহামায়াকে নির্দেশ দেন হিমালয়ের কন্যা পার্বতী রূপে জন্মগ্রহণ করতে। পার্বতী আবার শিবের মতো পুত্রলাভের আশায় শিবের তপস্যায় রত হলেন আর এই সময় তিনি পূর্ণ উপবাসে ছিলেন, একটি পাতাও তিনি মুখে দেননি। তাই পার্বতীর অপর নাম হয় অপর্ণা। শিব তপস্যায় সন্তুষ্ট হলেন আর ইতিমধ্যে দেবতাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী শিবের ধ্যানভঙ্গ হওয়া মাত্র মদনদেবের জোড়া পঞ্চবালে শিবের মধ্যে কাম জাগ্রত হয় এবং পার্বতীর সঙ্গে তিনি মিলিত হন। শিব ও শক্তিরূপিনী পার্বতীর মিলনের ফলে এক ভীষণ তেজোদীপ্ত অগ্নিপিণ্ডের উৎপত্তি ঘটে যার তেজ অগ্নিদেব, গঙ্গা কেউই সহ্য করে না পারায় তাকে এক বনের মধ্যে ছয়জন কৃত্তিকার গর্ভে ভাগ করে দেওয়া হয়। এর ফলেই ছয়টি মাথাবিশিষ্ট কার্তিকের জন্ম হয়। দেবসেনাপতি নিযুক্ত হয়ে ছয়দিন ধরে যুদ্ধ করে তিনি তারকাসুরকে বধ করেন। যদিও এই কাহিনীরও বিশেষ বিশেষ রূপভেদ রয়েছে। কৃত্তিকার গর্ভে জন্ম হয় বলে তাঁর নাম হয় কার্তিক। ‘স্কন্দ’ পুরাণে কার্তিকের বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়। মহাভারতের কাহিনীতেও কার্তিককে ‘স্কন্দ’ নামেই অভিহিত করা হয়েছে। যে ছয়জন কৃত্তিকার কাছে লালিত-পালিত হয়েছিলেন তারা ছিলেন ঋষিপত্নী এবং কৃত্তিকাদের সঙ্গে পরপুরুষের সম্পর্ক আছে সন্দেহ করে ঋষিরা তাঁদের তাড়িয়ে দেন। মায়ের সম্মান অর্জনের জন্য কার্তিক সেই কৃত্তিকাদের অনুর্ধ্ব ষোল বছর বয়সী ছেলে-মেয়েদের নানাবিধ অনিষ্ট করতে বলেন এবং অপদেবতাদের গর্ভের ভ্রূণ নষ্ট করার আদেশ দেন। এমতাবস্থায় সন্তানাদি না হওয়ায় শোকে জর্জর্রিত হয়ে পড়েন মর্ত্যবাসী। এই সময়েই কার্তিকের পুজো করে পুত্রসন্তান প্রাপ্তির কথা প্রচারিত হয়ে যায়।
সন্তান কামনায় এবং সন্তানের মঙ্গল প্রার্থনায় কার্তিক সেই থেকেই ঘরে ঘরে পূজ্য হয়ে ওঠেন। তাই হিন্দুদের কাছে কার্তিক হল উর্বরতার প্রতীক। কার্তিকের স্ত্রী ষষ্ঠীদেবী জন্ম ও জন্মসূত্রের দেবী এবং অন্যদিকে কার্তিকের যোদ্ধা মনোভাবের কারণে বলিষ্ঠ ও সুন্দর সন্তান পাবার আশায় কার্তিক পূজিত হন। সন্তানহীন দম্পতিরা তাই কার্তিক মাসে এই পুজো করে থাকেন।