বৈশালী মণ্ডল ঃ ষোড়শ-সপ্তদশ শতক। সে সময় আদিগঙ্গা বা ভাগীরথী নদীর তীরবর্তী স্থানগুলি ছিল গভীর জঙ্গলে ভরা এবং নিরিবিলি। তন্ত্রসাধকরা গড়ে তুলছিলেন শক্তিসাধনার ক্ষেত্র। লোকালয় থেকে বেশ খানিকটা দূরে গড়ে উঠছিল এই শক্তিসাধনার ক্ষেত্রগুলি। এরকমই একটি ক্ষেত্র হল দক্ষিণ ২৪ পরগনার মজিলপুরের ধন্বন্তরী কালী মন্দির। যাঁর প্রসিদ্ধি এখন সারা বাংলা জুড়ে।
রেল লাইনের পূর্বদিকে মজিলপুর গ্রাম। পশ্চিমে মোয়ার জন্য বিখ্যাত জয়নগর। মনে হয় আদিগঙ্গার মজে যাওয়া গর্ভে স্থানটির সৃষ্টি বলে নাম হয়েছে মজিলপুর। মজিলপুর পদ্মপুকুর নামেও খ্যাত।
মজিলপুরের ধন্বন্তরী মাকে দর্শন করতে হলে ট্রেনে করে আসাই ভাল। শিয়ালদহ দক্ষিণ শাখায় গিয়ে নামখানা বা লক্ষ্মীকান্তপুর লোকাল ধরতে হবে। নামতে হবে জয়নগর-মজিলপুর স্টেশনে। ট্রেন লাইন বরাবর মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই পড়বে পিচ রাস্তা। সেই রাস্তা ধরে কয়েক পা এগোলেই চোখে পড়বে ধন্বন্তরী মায়ের মন্দির। স্টেশনে নেমে ভ্যানে করেও যাওয়া যায় মায়ের মন্দিরে।
মজিলপুরের ঠাকুরবাড়ির আদিপুরুষ ছিলেন রাজেন্দ্রলাল চক্রবর্তী। পরিব্রাজকরূপে ভ্রমণকালে ভৈরবানন্দ নামে এক তন্ত্রসাধকের সাহচর্য লাভ ও শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন তিনি। সময়টা ছিল সপ্তদশ শতকের মধ্যভাগ। জনশ্রুতি আছে, ভৈরবানন্দ স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে পদ্মপুকুর নামে জলাশয় থেকে ৩০০ বছরের প্রাচীন একটি বিগ্রহ পান। বিগ্রহটিকে প্রতিষ্ঠা করেন তাঁরই নির্মিত একটি ছোট্ট কুটিরে। ইনিই হলেন মা ধন্বন্তরী কালী।
সেই সময়েই একদিন রাজেন্দ্রলাল রায়কে স্বপ্নে দেখা দেন দেবী ধন্বন্তরী। পুকুরের কাছে পড়ে থাকা একটি নিম কাঠ থেকে দেবী বিগ্রহ তৈরির আদেশ দেন মা। পাথর বিগ্রহের স্থলে নির্মিত হয় নিমকাঠের বিগ্রহ। এই নিমকাঠের বিগ্রহ পূজিত হয়ে আসছে আজও। পরবর্তীকালে অবশ্য বড় হয়েছে মন্দির প্রাঙ্গণ।
সমতল ছাদবিশিষ্ট কালীমন্দিরটি দক্ষিণমুখী। গর্ভমন্দিরে বেদির উপরে রয়েছে একটি কারুকার্যখচিত কাঠের রথসিংহাসন। তাতে পদ্মের উপরে শুয়ে আছেন মহাদেব। তাঁরই বক্ষস্থলে দাঁড়িয়ে অপরূপা দীপ্তিময়ী দেবী কালিকা। মহাদেবের মাথাটি দেবীর সামনের দিকে। শ্রীচরণে মল, দুটি কান কুণ্ডলশোভিত। বসন পরিহিতা দেবীর এলানো কেশ কোমর ছাড়িয়ে। সালঙ্কারা। ত্রিনয়নী দক্ষিণাকালী। নিকষকালো কষ্টিপাথরে নির্মিত বিগ্রহ। চোখ ও মনের তৃপ্তি দেয় এই মাতৃবিগ্রহ। দেবীমূর্তির পাশে দুটি ঘরে রয়েছে দুটি শিবলিঙ্গ।
বর্তমান মন্দিরের সেবায়েত কালিদাস চক্রবর্তী মন্দির প্রসঙ্গে অনেক অজানা তথ্য তুলে ধরেন আমাদের কাছে। তিনি জানান, মন্দিরটি সাড়ে তিনশো থেকে চারশো বছরের প্রাচীন। মজিলপুর নামের উদ্ভব নিয়ে নদীর মজে যাওয়া তত্ত্বে দ্বিমত নেই তাঁর। রেললাইনের ওপারে মা জয়চন্ডী অধিষ্ঠান করছেন বলে জানান তিনি, এই জয়চন্ডী ধন্বন্তরী মায়ের থেকেও ৪০০-৫০০ বছরের প্রাচীন। তিনি আরও জানান নদী-সংলগ্ন স্থানেই একটি বিরাট শ্মশান ছিল। সেখানে বসবাস করতেন এক সন্ন্যাসী। তিনিই সেবা করতেন মা ধন্বন্তরীকে। নদী মজে যাওয়ার আগে নদীপথেই বাণিজ্য করতেন দেশ-বিদেশের বহু জমিদার। একদিন রাত হয়ে যাওয়াতে কোনও এক জমিদার ডাকাতের ভয়ে এগোতে পারেননি নদীবক্ষে। নোঙর রেখে আশ্রয় নেন সন্ন্যাসীর কুটিরে। মাকে দেখে ভক্তি জন্মায় তাঁর অন্তরে। তারপর যাতায়াতের পথে মাঝে মাঝেই আসতেন সন্ন্যাসীর কাছে। একদিন সন্ন্যাসী অনুরোধ করেন ওই জমিদারকে। মা-কে প্রতিষ্ঠা করার অনুরোধ। অনুরোধ ফেলতে পারেননি জমিদার। মাকে নিয়ে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন তিনিই। সেই জমিদারই পরবর্তীকালে মায়ের স্বপ্নাদেশ পেয়ে দারু মূর্তি গড়ান। মূর্তিটি এককাঠের।
সেবায়েত আরও জানান, ধন্বন্তরী নামটি পরবর্তী কালের। ধন্বন্তরী হলেন দেবতাদের কবিরাজ। যিনি মরা মানুষকেও বাঁচিয়ে তুলতেন। ধন্বন্তরী মা নন, তিনি বাবা। মায়ের একটা স্বপ্নাদিষ্ট ওষুধ আছে, অব্যর্থ ওষুধ। গ্যাস, অম্বল জাতীয় রোগে এটি কাজ করে। সেই ওষুধ খেয়েই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠত রোগীরা। ওষুধটা ধন্বন্তরীর মত কাজ দিত বলে সবাই মাকে ধন্বন্তরী বলেই ডাকত। সেই থেকেই মায়ের নাম ধন্বন্তরী।
সেই সপ্তদশ শতাব্দী থেকে দেবীর নিত্যসেবাপুজো আজও চলে আসছে অপ্রতিহত গতিতে। কালীপুজো, অমাবস্যা, শনি-মঙ্গলবার এই দিনগুলি বাদ দিলেও প্রতিদিনই হাজারো পুণ্যার্থী ভিড় জমান মন্দির প্রাঙ্গণে। তবে বার্ষিক পুজো হয় বৈশাখ মাসে। সেই সময়ে মন্দির প্রাঙ্গণে ১৫ দিন ধরে চলে মেলা। সবচেয়ে বিস্ময়কর হল, এই ১৫ দিনই পরিবর্তিত হয় দেবীর বেশ। দূর-দূরান্ত থেকে আসেন ভক্তবৃন্দ।