Home » “রথযাত্রা, লোকারণ্য, মহা ধুমধাম, ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম। পথ ভাবে আমি দেব রথ ভাবে আমি, মূর্তি ভাবে আমি দেব—হাসে অন্তর্যামী।”

“রথযাত্রা, লোকারণ্য, মহা ধুমধাম, ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম। পথ ভাবে আমি দেব রথ ভাবে আমি, মূর্তি ভাবে আমি দেব—হাসে অন্তর্যামী।”

বৈশালী মণ্ডলঃ  ১ জুলাই ২০২২ (১৬ আষাঢ়)মাসে পালিত হবে এই পবিত্র জগন্নাথ যাত্রা।

জগন্নাথের আবির্ভাব কথাঃ

পদ্মপুরাণে বর্ণিত আছে, মালবরাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন বিষ্ণুর পরম ভক্ত ছিলেন৷ তিনি গড়ে তুলেছিলেন একটি মন্দির, নাম শ্রীক্ষেত্র (যা এখন জগন্নাথধাম হিসেবে পরিচিত)। কিন্তু মন্দিরে কোনো বিগ্রহ ছিল না। একদিন রাজসভায় কেউ একজন বললেন নীলমাধবের কথা। নীলমাধব নাকি বিষ্ণুর এক রূপ। তাঁকে কোথায় পাওয়া যাবে? জানা নেই কারো। তাই আয়োজন করে নীলমাধবকে খুঁজতে লোকজন পাঠালেন রাজা৷ কিন্তু নীলমাধব কি অত সহজে দেখা দেয়? কেউ তাকে খুঁজে পেল না৷ সকলেই যখন হতাশ হয়ে ফিলে এলো, তখন দেখা গেল না কেবল বিদ্যাপতিকে। জঙ্গলে পথ হারালেন তিনি। এরপর গল্পে প্রেমের ছোঁয়া লাগলো। হারিয়ে যাওয়া বিদ্যাপতিকে জঙ্গলে উদ্ধার করলেন শবররাজ বিশ্ববসুর কন্যা ললিতা। সেই সূত্রে তাদের মাঝে ভাব জমে ওঠে, ধীরে ধীরে তা প্রেমে পরিণত হয়। কিছুকাল প্রেম, এরপর বিয়ে করে জঙ্গলে দিব্যি সংসার করতে লাগলেন নবদম্পতি ললিতা আর বিদ্যাপতি।

এদিকে বিদ্যাপতি লক্ষ্য করলেন, রোজই তার শ্বশুরমশাই স্নান সেরে কোথাও যান। স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন, জঙ্গলের গহীনে নীল পর্বতে নীলমাধবের মূর্তি রয়েছে। বিশ্ববসু সেখানেই রোজ নীলমাধবের পূজা দিতে যান। নীলমাধবের কথা জানতে পেরে খুশিতে আটখানা হলেন বিদ্যাপতি। তার হারিয়ে যাওয়া যেন সার্থক হলো! জানা মাত্রই বিশ্ববসুর কাছে অনুরোধ করলেন নীলমাধবের দর্শনের জন্য। প্রথমে নারাজ হলেও নাছোড়বান্দা জামাইয়ের অনুরোধ শেষতক মেনে নিতে হলো বিশ্ববসুকে। নীলমাধবের দর্শন পেয়ে তৎক্ষণাৎ ভক্তি ভরে পূজা করলেন বিদ্যাপতি। আর তখনই আকাশ থেকে দৈববাণী ভেসে এলো.

নীলমাধব যখন স্বয়ং রাজা ইন্দ্রদুম্ন্যের পূজো নিতে চান, তখন কি আর দেরি করা যায়? চটজলদি খবর পাঠানো হলো রাজা ইন্দ্র্যদ্যুম্নের কাছে। রাজা বিস্ময়ে মহানন্দে সব ব্যবস্থা করে হাজির হলেন জঙ্গলের মাঝে নীলমাধবকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু জঙ্গলে পৌঁছনো মাত্রই আর কোনো খোঁজ পাওয়া গেলো না নীলমাধবের। তখন আবার দৈববাণী শোনা গেলো

সবাইকে অবাক করে দিয়ে হঠাৎই একদিন সমুদ্রের জলে কাঠ ভেসে এলো। মহাসমারোহে শুরু হলো বিগ্রহ তৈরির কাজ। কিন্তু কীভাবে তৈরি হবে? ভেসে আসা কাঠ এমনই শক্ত যে মূর্তি গড়া তো দূরে থাক, কেউ হাতুড়িই বসাতে পারল না কাঠে; উল্টো হাতুড়িরই যায় যায় অবস্থা! তাহলে মূর্তি গড়বে কে? মহারাজ আবারও পড়লেন বিপদে৷ ইন্দ্রদ্যুম্নের সেই অসহায় অবস্থা দেখে বুঝি এবার দুঃখ হলো ভগবানের। শিল্পীর রূপ ধরে স্বয়ং জগন্নাথ এসে দাঁড়ালেন রাজপ্রাসাদের দরজায়৷ বললেন, তিনিই গড়বেন ভগবানের বিগ্রহ। তবে তার একটি শর্ত আছে৷ শর্তটি এমন যে তিন সপ্তাহ বা ২১ দিনের পূর্বে কেউ তাঁর কাষ্ঠমূর্তি নির্মাণ দেখতে পারবে না। অতঃপর শর্তানুযায়ী কাজ আরম্ভ করলেন দারুশিল্পী। কিন্তু ইন্দ্রদ্যুম্নের রানী গুণ্ডিচার তর সইলো না।

একদিন ভেতর থেকে কোনো আওয়াজ না পেয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়লেন এবং দেখলেন, কারিগর উধাও! সাথে তিনটি অর্ধসমাপ্ত মূর্তি দেখে তো রীতিমতো ভিরমি খেলেন তিনি! গোল গোল চোখ, গাত্র বর্ণসহ অসমাপ্ত মূর্তির না আছে হাত, না আছে পা। এ অবস্থা দেখে অনুশোচনায় আর দুঃখে বিহ্বল হয়ে পড়লেন রাজা-রানী দুজনেই৷ ভাবলেন, শর্ত খণ্ডনের ফলেই বুঝি এত বড় শাস্তি পেলেন তারা। তবে তাদের এই অনুশোচনা পর্ব দীর্ঘায়িত হতে দেননি ভগবান। স্বপ্নে উপস্থিত হয়ে জগন্নাথ জানিয়ে দিলেন, “এমনটা আগে থেকেই ঠিক করা ছিল৷ আমি এই রূপেই পূজিত হতে চাই”। এরপর থেকে এভাবেই ভক্তদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করেন জগন্নাথদেব৷

উৎসবঃ

স্কন্ধপুরাণে সরাসরিভাবে জগন্নাথদেবের রথযাত্রার কথা পাওয়া যায়। সেখানে ‘পুরুষোত্তম ক্ষেত্র মাহাত্ম্য’ কথাটি উল্লেখ করে মহর্ষি জৈমিনি রথের আকার, সাজসজ্জা, পরিমাপ ইত্যাদির বর্ণনা দিয়েছেন। ‘পুরুষোত্তম ক্ষেত্র’ বা ‘শ্রীক্ষেত্র’ বলতে আসলে পুরীকেই বোঝায়। পুরীতেই যেহেতু জগন্নাথ দেবের মন্দির স্থাপিত, তাই এই মন্দিরকে পবিত্রতম স্থান বলে মনে করা হয় এবং এর অন্যতম আকর্ষণ রথযাত্রা। প্রতি বছর রথযাত্রার উদ্বোধন করেন সেখানকার রাজা। রাজত্ব না থাকলেও বংশপরম্পরা ক্রমে পুরীর রাজপরিবার আজও আছে। সেই রাজপরিবারের নিয়ম অনুসারে, যিনি রাজা উপাধি প্রাপ্ত হন, তিনিই পুরীর রাজা জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রাদেবীর পর পর তিনটি রথের সামনে পুষ্পাঞ্জলি প্রদান করেন এবং সোনার ঝাড়ু ও সুগন্ধী জল দিয়ে রথের সম্মুখভাগ ঝাঁট দেন। তারপরই পুরীর রথের রশিতে টান পড়ে। শুরু হয় জগন্নাথদেবের রথযাত্রা। তিনজনের জন্য আলাদা আলাদা তিনটি রথ। রথযাত্রা উৎসবের মূল দর্শনীয় দিকটিও হল এই রথ তিনটি। তিনটি রথ যাত্রার কিছু নিয়ম রয়েছে এবং রথের আকার, রঙেও ভিন্নতা দেখা যায়।

  • প্রথমে যাত্রা শুরু করে বড় ভাই বলভদ্রের রথ। এই রথের নাম তালধ্বজ। রথটির চৌদ্দটি চাকা। উচ্চতা চুয়াল্লিশ ফুট। রথের আবরণের রঙ নীল।
  • তারপর যাত্রা করে বোন সুভদ্রার রথ। রথের নাম দর্পদলন। উচ্চতা প্রায় তেতাল্লিশ ফুট। এই রথের মোট বারোটি চাকা। যেহেতু রথটির ধ্বজা বা পতাকায় পদ্মচিহ্ন আঁকা রয়েছে, তাই রথটিকে পদ্মধ্বজও বলা হয়ে থাকে। রথের আবরণের রঙ লাল।
  • সর্বশেষে থাকে শ্রী কৃষ্ণ বা জগন্নাথদেবের রথ। রথটির নাম নন্দীঘোষ। পতাকায় কপিরাজ হনুমানের মূর্তি আঁকা রয়েছে তাই এই রথের আর একটি নাম কপিধ্বজ। রথটির উচ্চতা পঁয়তাল্লিশ ফুট। এতে ষোলোটি চাকা আছে। রথটির আবরণের রঙ হলুদ।

সেখানে সাতদিন থাকার পর আবার উল্টো রথে জগন্নাথ মন্দিরে ফিরে আসে। আজ থেকে আনুমানিক সাতশো বছর পূর্বে রথযাত্রার যাত্রাপথ দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল। আর সেই দুটি ভাগে তিনটি-তিনটি করে মোট ছ’টি রথ ব্যবহৃত হতো। কেননা, সেসময় জগন্নাথ মন্দির থেকে গুণ্ডিচা আসার পথটির মাঝখান দিয়ে বয়ে যেতো এক প্রশস্ত বলাগুণ্ডি নালা। তাই জগন্নাথ মন্দির থেকে তিনটি রথ বলাগুণ্ডি নালার পার পর্যন্ত এলে পরে জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার মূর্তি রথ থেকে নামিয়ে নালা পার করে অপর পাড়ে অপেক্ষমাণ অন্য তিনটি রথে বসিয়ে ফের যাত্রা শুরু হতো। ১২৮২ খ্রিস্টাব্দে, রাজা কেশরী নরসিংহ পুরীর রাজ্যভার গ্রহণের পর তাঁর রাজত্বকালের কোনো এক সময়ে এই বলাগুণ্ডি নালা বুজিয়ে দেন। সেই থেকে পুরীর রথযাত্রায় তিনটি রথ। রথের সময় প্রায় পনেরো-বিশ লক্ষ হিন্দু ধর্মাবলম্বী রথযাত্রায় অংশ নিতে দেশ-বিদেশ থেকে ছুটে আসেন পুরীতে। শাস্ত্রে রয়েছে, “রথস্থ বাম নং দৃষ্টাপুনর্জন্ম ন বিদ্যতে”৷ অর্থাৎ রথের উপর অধিষ্ঠিত বামন জগন্নাথকে দর্শন করলে তাঁর পুনর্জন্ম হয় না৷ তাই রথের দড়ি টানাকেও পুণ্যের কাজ হিসাবে গণ্য করেন ধর্মপ্রাণ হিন্দুরা।

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Click to Go Up
error: Content is protected !!